দুর্গেশনন্দিনী
তিনি কহিলেন, ‘আশমানিকে জিজ্ঞাসা কর; তাহার সমভিব্যাহারে বারিবাহক দাস সাজিয়া পুরীমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলাম; সেই পর্যন্ত লুক্কায়িত আছি |’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এখন?’
তিনি কহিলেন, ‘আর কি? তুমি যাহা কর |’
আমি চিন্তা করিতে লাগিলাম, কি করি? কোন্ দিক রাখি? চিত্ত যে দিকে লয়, সেই দিকে মতি হইতে লাগিল। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে অকস্মাৎ আমার শয়নকক্ষের দ্বার মুক্ত হইয়া গেল। সম্মুখে দেখি, মহারাজ মানসিংহ!
বিস্তারে আবশ্যক কি? বীরেন্দ্রসিংহ কারাগারে আবদ্ধ হইলেন। মহারাজ এরূপ প্রকাশ করিলেন যে, তাঁহাকে রাজদণ্ডে দণ্ডিত করিবেন। আমার হৃদয়মধ্যে কিরূপ হইতে লাগিল, তাহা বোধ করি বুঝিতে পারিবেন। আমি কান্দিয়া ঊর্মিলা দেবীর পদতলে পড়িলাম, আত্মদোষ সকল ব্যক্ত করিলাম; সকল দোষ আপনার স্কন্ধে স্বীকার করিয়া লইলাম। পিতার সহিত সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারও চরণে লুণ্ঠিত হইলাম। মহারাজ তাঁহাকে ভক্তি করেন; তাঁহাকে গুরুবৎ শ্রদ্ধা করেন; অবশ্য তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিবেন। কহিলাম, ‘আপনার জ্যেষ্ঠা কন্যাকে স্মরণ করুন।’ বোধ করি, পিতা মহারাজের সহিত একত্র যুক্তি করিয়াছিলেন। তিনি আমার রোদনে কর্ণপাতও করিলেন না। রুষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘পাপীয়সি! তুই একেবারে লজ্জা ত্যাগ করিয়াছিস!’
ঊর্মিলা দেবী আমার প্রাণরক্ষার্থ মহারাজের নিকট বহুবিধ কহিলেন, মহারাজ কহিলেন, ‘আমি তবে চোরকে মুক্ত করি, সে যদি বিমলাকে বিবাহ করে |’
আমি তখন মহারাজের অভিসন্ধি বুঝিয়া নি:শব্দ হইলাম। প্রাণেশ্বর মহারাজের বাক্যে বিষম রুষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘আমি যাবজ্জীবন কারাগারে থাকিব, সেও ভাল; প্রাণদণ্ড নিব, সেও ভাল; তথাপি শূদ্রী-কন্যাকে কখন বিবাহ করিব না। আপনি হিন্দু হইয়া কি প্রকারে এমন অনুরোধ করিতেছেন?’
মহারাজ কহিলেন, ‘যখন আমার ভগিনীকে শাহজাদা সেলিমের সহিত বিবাহ দিতে পারিয়াছি, তখন তোমাকে ব্রাহ্মণকন্যাকে বিবাহ করিতে অনুরোধ করিব, বিচিত্র কি?’
তথাপি তিনি সম্মতি হইলেন না। বরং কহিলেন, ‘মহারাজ, যাহা হইবার, তাহা হইল। আমাকে মুক্তি দিউন, আমি বিমলার আর কখনও নাম করিব না |’
মহারাজ কহিলেন, ‘তাহা হইলে তুমি যে অপরাধ করিয়াছ, তাহার প্রায়শ্চিত্ত হইল কই? তুমি বিমলাকে ত্যাগ করিবে, অন্য জনে তাহাকে কলঙ্কিনী বলিয়া ঘৃণা করিয়া স্পর্শ করিবে না |’
তথাপি আশু তাঁহার বিবাহে মতি লইল না। পরিশেষে যখন আর কারাগার-যন্ত্রণা সহ্য হইল না, তখন অগত্যা অর্ধসম্মত হইয়া কহিলেন, ‘বিমলা যদি আমার গৃহে পরিচারিকা হইয়া থাকিতে পারে, বিবাহের কথা আমার জীবিতকালে কখন উত্থাপন না করে, আমার ধর্মপত্নী বলিয়া কখন পরিচয় না দেয়, তবে শূদ্রীকে বিবাহ করি, নচেৎ নহে |’
আমি বিপুল পুলকসহকারে তাহাই স্বীকার করিলাম। আমি ধন গৌরব পরিচয়াদির জন্য কাতর ছিলাম না। পিতা এবং মহারাজ উভয়েই সম্মত হইলেন। আমি দাসীবেশে রাজভবন হইতে নিজ ভর্তৃভবনে আসিলাম।
অনিচ্ছায়, পরবল-পীড়ায় তিনি আমাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। এমন অবস্থায় বিবাহ করিলে কে স্ত্রীকে আদর করিতে পারে? বিবাহের পরে প্রভু আমাকে বিষ দেখিতে লাগিলেন। পূর্বের প্রণয় তৎকালে একেবারে দূর হইল। মহারাজ মানসিংহকৃত অপমান সর্বদা স্মরণ করিয়া আমাকে তিরস্কার করিতেন, সে তিরস্কারও আমার আদর বোধ হইত। এইরূপে কিছুকাল গেল; কিন্তু সে সকল পরিচয়েই বা প্রয়োজন কি? আমার পরিচয় দেওয়া হইয়াছে, অন্য কথা আবশ্যক নহে। কালে আমি পুনর্বার স্বামিপ্রণয়ভাগিনী হইয়াছিলাম, কিন্তু অম্বরপতির প্রতি তাঁহার পূর্ববৎ বিষদৃষ্টি রহিল। কপালের লিখন! নচেৎ এ সব ঘটিবে কেন?