ওসমান পাঠানকুলতিলক। যুদ্ধ তাঁহার স্বার্থসাধন ও নিজ ব্যবসায় এবং ধর্ম; সুতরাং যুদ্ধজয়ার্থ ওসমান কোন কার্যেই সঙ্কোচ করিতেন না। কিন্তু যুদ্ধ প্রয়োজন সিদ্ধ হইলে পরাজিত পক্ষের প্রতি কদাচিৎ নিষ্প্রয়োজনে তিলার্ধ অত্যাচার করিতে দিতেন না। যদি কতলু খাঁ স্বয়ং বিমলা, তিলোত্তমার অদৃষ্টে এ দারুণ বিধান না করিতেন, তবে ওসমানের কৃপায় তাঁহারা কদাচ বন্দী থাকিতেন না। তাঁহারই অনুকম্পায় স্বামীর মৃত্যুকালে বিমলা তৎসাক্ষাৎ লাভ করিয়াছিলেন। পরে যখন ওসমান জানিতে পারিলেন যে, বিমলা বীরেন্দ্রসিংহের স্ত্রী, তখন তাহার দয়ার্দ্র চিত্ত আরও আর্দ্রীভূত হইল। ওসমান কতলু খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র, এজন্য অন্ত:পুরেও কোথাও তাঁহার গমনে বারণ ছিল না, ইহা পূর্বেই দৃষ্ট হইয়াছে। যে বিহারগৃহে কতলু খাঁর উপপত্নীসমূহ থাকিত, সে স্থলে কতলু খাঁর পুত্রেরাও যাইতে পারিতেন না, ওসমানও নহে। কিন্তু ওসমান কতলু খাঁর দক্ষিণ হস্ত, ওসমানের বাহুবলেই তিনি আমোদর তীর পর্যন্ত উৎকল অধিকার করিয়াছিলেন। সুতরাং পৌরজন প্রায় কতলু খাঁর যাদৃশ, ওসমানের তাদৃশ বাধ্য ছিল। এজন্যই অদ্য প্রাতে বিমলার প্রার্থনানুসারে, চরমকালে তাঁহার স্বামিসন্দর্শন ঘটিয়াছিল।

বৈধব্য-ঘটনার দুই দিবস পরে বিমলার যে কিছু অলঙ্কারাদি অবশিষ্ট ছিল, তৎসমুদায় লইয়া তিনি কতলু খাঁর নিয়োজিত দাসীকে দিলেন। দাসী কহিল, “আমায় কি আজ্ঞা করিতেছেন?”

বিমলা কহিলেন, “তুমি যেরূপ কাল ওসমানের নিকট গিয়াছিলেন, সেইরূপ আর একবার যাও; কহিও যে, আমি তাঁহার নিকট আর একবার সাক্ষাতের প্রার্থিতা; বলিও এই শেষ, আর তৃতীয়বার ভিক্ষা করিব না |”

দাসী সেইরূপ করিল। ওসমান বলিয়া পাঠাইলেন, “সে মহাল মধ্যে যাতায়াতে উভয়েরই সঙ্কট; তাঁহাকে আমার আবাসমন্দিরে আসিতে কহিও |”

বিমলা জিজ্ঞেস করিলেন, “আমি যাই কি প্রকারে?” দাসী কহিল, “তিনি কহিয়াছেন যে, তিনি তাহার উপায় করিয়া দিবেন |”

সন্ধ্যার পর আয়েষার একজন দাসী আসিয়া অন্ত:পুররক্ষী খোজাদিগের সহিত কি কথাবার্তা কহিয়া বিমলাকে সমভিব্যাহারে করিয়া ওসমানের নিকট লইয়া গেল।

ওসমান কহিলেন, “আর তোমার কোন অংশে উপকার করিতে পারি?” বিমলা কহিলেন, “অতি সামান্য কথামাত্র; রাজপুতকুমার জগৎসিংহ কি জীবিত আছেন?”

ও। জীবিত আছেন।

বি। স্বাধীন আছেন কি বন্দী আছেন?

ও। বন্দী বটে, কিন্তু আপাতত: কারাগারে নহে। তাঁহার অঙ্গের অস্ত্রক্ষতের হেতু পীড়িত হইয়া শয্যাগত আছেন। কতলু খাঁর অজ্ঞাতসারে তাঁহাকে অন্ত:পুরেই রাখিয়াছি। সেখানে বিশেষ যত্ন হইবে বলিয়া রাখিয়াছি।

বিমলা শুনিয়া বলিলেন, “এ অভাগিনীদের সম্পর্কমাত্রেই অমঙ্গল ঘটিয়াছে। সে সকল দেবতাকৃত। এক্ষণে যদি রাজপুত্র পুনর্জীবিত হয়েন, তবে তাঁহার আরোগ্যপ্রাপ্তির পর, এই পত্রখানি তাঁহাকে দিবেন; আপাতত: আপনার নিকট রাখিবেন। এইমাত্র আমার ভিক্ষা |”

ওসমান লিপি প্রত্যর্পণ করিয়া কহিলেন, “ইহা আমার অনুচিত কার্য; রাজপুত্র যে অবস্থাতেই থাকুন, তিনি বন্দী বলিয়া গণ্য। বন্দীদিগের নিকট কোন লিপি আমরা নিজে পাঠ না করিয়া যাইতে দেওয়া অবৈধ, এবং আমার প্রভুর আদেশবিরুদ্ধ |”

বিমলা কহিলেন, “এ লিপির মধ্যে আপনাদিগের অনিষ্টকারক কোন কথাই নাই, সুতরাং অবৈধ কার্য হইবে না। আর প্রভুর আদেশ? আপনি আপন প্রভু |”

ওসমান কহিলেন, “অন্যান্য বিষয়ে আমি পিতৃব্যের আদেশবিরুদ্ধ আচরণ কখন করিতে পারি; কিন্তু এ সকল বিষয়ে নহে। আপনি যখন কহিতেছেন যে, এই লিপিমধ্যে বিরুদ্ধ কথা নাই, তখন সেইরূপই আমার প্রতীত হইতেছে, কিন্তু এ বিষয়ে নিয়ম ভঙ্গ করিতে পারি না। আমা হইতে এ কার্য হইবে না |”

বিমলা ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, “তবে আপনি পাঠ করিয়াই দিবেন |”
ওসমান লিপি গ্রহণ করিয়া পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন।