রজনী
প্রথম পরিচ্ছেদ
ইহার কয় বৎসর পরে এমন একটি ঘটনা ঘটিল যে, তাহা আমি বলিতে পারিতেছি না। পশ্চাৎ বলিব কিনা, তাহাও স্থির করিতে পারিতেছি না। সেই অবধি আমি গৃহত্যাগ করিলাম। সেই পর্যন্ত নানা দেশে ভ্রমণ করিয়া বেড়াই। কোথাও স্থায়ী হইতে পারি নাই।
কোথাও স্থায়ী হই নাই, কিন্তু মনে করিলেই স্থায়ী হইতে পারিতাম। মনে করিলে কুলীন ব্রাহ্মণের অপেক্ষা অধিক বিবাহ করিতে পারিতাম। আমার সব ছিল-ধন, সম্পদ, বয়স, বিদ্যা, বাহুবল-কিছুরই অভাব ছিল না; অদৃষ্টদোষে, একদিনের দুর্বুদ্ধিদোষে, সকল ত্যাগ করিয়া, আমি এই সুখময় গৃহ-এই উদ্যানতুল্য পুষ্পময় সংসার ত্যাগ করিয়া, বাত্যাতাড়িত পতঙ্গের মত দেশে দেশে বেড়াইলাম। আমি মনে করিলে আমার সেই জন্মভূমিতে রম্য গৃহ রম্য সজ্জায় সাজাইয়া, রঙ্গের পবনে সুখের নিশান উড়াইয়া দিয়া, হাসির বাণে দু:খরাক্ষসকে বধ করিতে পারিতাম। কিন্তু-
এখন তাই ভাবি, কেন করিলাম না। সুখদু:খের বিধান পরের হাতে, কিন্তু মন ত আমার। তরঙ্গে নৌকা ডুবিল বলিয়া, কেন ডুবিয়া রহিলাম-সাঁতার দিয়া ত কূল পাওয়া যায়। আর দু:খ-দু:খ কি? মনের অবস্থা, সে ত নিজের আয়ত্ত। সুখদু:খ পরের হাত, না আমার নিজের হাত? পর কেবল বহির্জগতের কর্তা-অন্তর্জগতে আমি একা কর্তা। আমার রাজ্য লইয়া আমি সুখী হইতে পারি না কেন? জড়জগৎ জগৎ, অন্তর্জগৎ কি জগৎ নয়? আপনার মন লইয়া কি থাকা যায় না? তোমার বাহ্য জগতে কয়টি সামগ্রী আছে, আমার অন্তরে কি বা নাই? আমার অন্তরে যাহা আছে, তাহা তোমার বাহ্য জগৎ দেখাইবে, সাধ্য কি? যে কুসুম এ মৃত্তিকায় ফুটে, যে বায়ু এ আকাশে বয়, যে চাঁদ এ গগনে উঠে, যে সাগর এ অন্ধকারে আপনি মাতে, তোমার বাহ্য জগতে তেমন কোথায়?
তবে কেন, সেই নিশীথকালে, সুষুপ্তা সুন্দরীর সৌন্দর্যপ্রভা-দূর হৌক! একদিন নিশীথকালে-এই অসীম পৃথিবী সহসা আমার চক্ষে শুষ্ক বদরীর মত ক্ষুদ্র হইয়া গেল-আমি লুকাইবার স্থান পাইলাম না। দেশে দেশে ফিরিলাম।