দুর্গেশনন্দিনী
ক। তাহাই হইবে, আর কিছু?
উত্তর। এ জন্মে আর কিছু না |
ক। মৃত্যুকালে তোমার কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিবে না?
এই প্রশ্ন শুনিয়া দ্রষ্টৃবর্গ পরিতাপে নি:শব্দ হইল, বীরেন্দ্রের চক্ষে আবার উজ্জ্বলাগ্নি জ্বলিতে লাগিল।
“যদি আমার কন্যা তোমার গৃহে জীবিতা থাকে, তবে সাক্ষাৎ করিব না। যদি মরিয়া থাকে, লইয়া আইস, কোলে করিয়া মরিব |”
দ্রষ্টৃবর্গ একেবারে নীরব, অগণিত লোক এতাদৃশ গভীর নিস্তব্ধ যে, সূচীপাত হইলে শব্দ শুনা যাইত। নবাবের ঈঙ্গিত পাইয়া, রক্ষিবর্গ বীরেন্দ্রসিংহকে বধ্যভূমিতে লইয়া চলিল। তথায় উপনীত হইবার কিছু পূর্বে একজন মুসলমান বীরেন্দ্রের কাণে কাণে কি কহিল; বীরেন্দ্র তাহা কিছু বুঝিতে পারিলেন না। মুসলমান তাঁহার হস্তে একখানি পত্র দিল। বীরেন্দ্র ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনে ঐ পত্র খুলিয়া দেখিলেন, বিমলার হস্তের লেখা। বীরেন্দ্র ঘোর বিরক্তির সহিত লিপি মর্দিত করিয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন। লিপি-বাহক লিপি তুলিয়া লইয়া গেল। নিকটস্থ কোন দর্শক বীরেন্দ্রের এই কর্ম দেখিয়া অপরকে অনুচ্চৈ:স্বরে কহিল, “বুঝি কন্যার পত্র?”
কথা বীরেন্দ্রের কাণে গেল। সেই দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “কে বলে আমার কন্যা? আমার কন্যা নাই |”
পত্রবাহক পত্র লইয়া গেল। রক্ষিবর্গকে কহিয়া গেল, “আমি যতক্ষণ প্রত্যাগমন না করি, ততক্ষণ বিলম্ব করিও |”
রক্ষিগণ কহিল, “যে আজ্ঞা প্রভো!”
স্বয়ং ওসমান পত্রবাহক; এই জন্য রক্ষিবর্গ প্রভু সম্বোধন করিল।
ওসমান লিপিহস্তে অন্ত:পুর-প্রাচীর মধ্যে গেলেন; তথায় এক বকুল-বৃক্ষের অন্তরালে এক অবগুণ্ঠনবতী স্ত্রীলোক দণ্ডায়মানা আছে। ওসমান তাহার সন্নিধানে গিয়া চতুর্দিক নিরীক্ষণ করিয়া যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা বিবৃত করিলেন। অবগুণ্ঠবতী কহিলেন, “আপনাকে বহু ক্লেশ দিতেছি, কিন্তু আপনা হইতেই আমাদের এ দশা ঘটিয়াছে। আপনাকে আমার এ কার্য সাধন করিতে হইবে |”
ওসমান নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন।
অবগুণ্ঠনবতী মন:পীড়া-বিকম্পিত স্বরে কহিতে লাগিলেন, “না করেন – না করুন, আমরা এক্ষণে অনাথা; কিন্তু জগদীশ্বর আছেন!”
ওসমান কহিলেন, “মা! তুমি জান না যে, কি কঠিন কর্মে আমায় নিযুক্ত করিতেছ। কতলু খাঁ জানিতে পারিলে আমার প্রাণান্ত করিবে |”
স্ত্রী কহিলেন, “কতলু খাঁ? আমাকে কেন প্রবঞ্চনা কর? কতলু খাঁর সাধ্য নাই যে, তোমার কেশ স্পর্শ করে|”
ও। কতলু খাঁকে চেন না । – কিন্তু চল, আমি তোমাকে বধ্যভূমিতে লইয়া যাইব।
ওসমানের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অবগুণ্ঠনবতী বধ্যভূমিতে গিয়া নিস্তব্ধে দণ্ডায়মানা হইলেন। বীরেন্দ্রসিংহ তাঁহাকে না দেখিয়া একজন ভিখারীর বেশধারী ব্রাহ্মণের সহিত কথা কহিতেছিলেন। অবগুণ্ঠনবতী অবগুণ্ঠনমধ্য হইতে দেখিলেন, ভিখারী অভিরাম স্বামী।