দুর্গেশনন্দিনী
বিমলা কহিলেন, “আমি তোমার বিলম্ব দেখিয়া মনে করিলাম, তুমি আমাকে ভুলিয়া গেলে, এজন্য তোমার তল্লাসে আসিয়াছিলাম। এখন আর বিলম্বে কাজ কি? তোমাদের দুর্গ অধিকার হইয়াছে; এই সময় পলাইবার উদ্যোগ দেখা ভাল |”
রহিম কহিল, “আজ না, কাল প্রাতে, আমি না বলিয়া কি প্রকারে যাইব? কাল প্রাতে সেনাপতির নিকট বিদায় লইয়া যাইব |”
বিমলা কহিলেন, “তবে চল, এই বেলা আমার অলঙ্কারাদি যাহা আছে, হস্তগত করিয়া রাখি; নচেৎ আর কোন সিপাহী লুঠ করিয়া লইবে |”
সৈনিক কহিল, “চল |” রহিমকে সমভিব্যাহারে লইবার তাৎপর্য এই যে, সে বিমলাকে অন্য সৈনিকের হস্ত হইতে রক্ষা হইতে পারিবে। বিমলার সতর্কতা অচিরাৎ প্রমাণীকৃত হইল। তাহারা কিয়দ্দূর যাইতে না যাইতেই আর এক দল অপহরণাসক্ত সেনার সম্মুখে পড়িল। বিমলাকে দেখিবামাত্র তাহারা কোলাহল করিয়া উঠিল, “ও রে, বড় শিকার মিলেছে রে!”
রহিম বলিল, “আপন আপন কর্ম কর ভাই সব, এদিকে নজর করিও না |”
সেনাগণ ভাব বুঝিয়া ক্ষান্ত হইল। একজন কহিল, “রহিম! তোমার ভাগ্য ভাল। এখন নবাব মুখের গ্রাস না কাড়িয়া লয় |”
রহিম ও বিমলা চলিয়া গেল। বিমলা রহিমকে নিজ শয়নকক্ষের নীচের কক্ষে লইয়া গিয়া কহিলেন, “এই আমার নীচের ঘর; এই ঘরের যে যে সামগ্রী লইতে ইচ্ছা হয়, সংগ্রহ কর; ইহার উপরে আমার শুইবার ঘর, আমি তথা হইতে অলঙ্কারাদি লইয়া শীঘ্র আসিতেছি।” এই বলিয়া তাহাকে এক গোছা চাবি ফেলিয়া দিলেন।
রহিম কক্ষে দ্রব্য সামগ্রী প্রচুর দেখিয়া হৃষ্টচিত্তে সিন্দুক পেটারা খুলিতে লাগিল। বিমলার প্রতি আর তিলার্ধ অবিশ্বাস রহিল না। বিমলা কক্ষ হইতে বাহির হইয়াই ঘরের বহির্দিকে শৃঙ্খল বদ্ধ করিয়া কুলুপ দিলেন। রহিম কক্ষমধ্যে বন্দী হইয়া রহিল।
বিমলা তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে উপরের ঘরে গেলেন। বিমলা ও তিলোত্তমার প্রকোষ্ঠ দুর্গের প্রান্তভাগে; সেখানে এ পর্যন্ত অত্যাচারকারী সেনা আইসে নাই; তিলোত্তমা ও জগৎসিংহ কোলাহলও শুনিতে পাইয়াছেন কি না সন্দেহ। বিমলা অকস্মাৎ তিলোত্তমার কক্ষমধ্যে প্রবেশ না করিয়া কৌতূহল প্রযুক্ত দ্বারমধ্যস্থ এক ক্ষুদ্র রন্ধ্র হইতে গোপনে তিলোত্তমার ও রাজকুমারের ভাব দেখিতে লাগিলেন। যাহার যে স্বভাব! এ সময়েও বিমলার কৌতূহল। যাহা দেখিলেন, তাহাতে কিছু বিস্মিত হইলেন।
তিলোত্তমা পালঙ্কে বসিয়া আছেন, জগৎসিংহ নিকটে দাঁড়াইয়া তাঁহার মুখমণ্ডল নিরীক্ষণ করিতেছেন। তিলোত্তমা রোদন করিতেছেন; জগৎসিংহও চক্ষু মুছিতেছেন।
বিমলা ভাবিলেন, “এ বুঝি বিদায়ের রোদন |”