দুর্গেশনন্দিনী
প্র। তোমাকে মনে থাকিবে না?
বি। মনের কথা তোমাকে বলিব?
প্র। বল না – বল।
বি। না, বলিব না, তুমি কি বলিবে?
প্র। না না - বল, আমাকে ভৃত্য বলিয়া জানিও।
বি। আমার মনে বড় ইচ্ছা হইতেছে, এ পাপ স্বামীর মুখে কালি দিয়া তোমার সঙ্গে চলিয়া যাই।
আবার সেই কটাক্ষ। প্রহরী আহ্লাদে নাচিয়া উঠিল।
প্র। যাবে?
দিগ্গসজের মত পণ্ডিত অনেক আছে!
বিমলা কহিলেন, “লইয়া যাও ত যাই!”
প্র। তোমাকে লইয়া যাইব না? তোমার দাস হইয়া থাকিব।
“তোমার এ ভালবাসার পুরস্কার কি দিব? ইহাই গ্রহণ কর |”
এই বলিয়া বিমলা কণ্ঠস্থ স্বর্ণহার প্রহরীর কণ্ঠে পরাইলেন, প্রহরী সশরীরে স্বর্গে গেল। বিমলা কহিতে লাগিলেন, “আমাদের শাস্ত্রে বলে, একের মালা অন্যের গলায় দিলে বিবাহ হয় |”
হাসিতে প্রহরীর কালো দাড়ির অন্ধকারমধ্য হইতে দাঁত বাহির হইয়া পড়িল; বলিল, “তবে ত তোমার সাতে আমার সাদি হইল |”
“হইল বই আর কি!” বিমলা ক্ষণেক কাল নিস্তব্ধে চিন্তামগ্নের ন্যায় রহিলেন। প্রহরী কহিল, “কি ভাবিতেছ?”
বি। ভাবিতেছি, আমার কপালে বুঝি সুখ নাই, তোমরা দুর্গজয় করিয়া যাইতে পারিবে না।
প্রহরী সদর্পে কহিল, “তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই, এতক্ষণ জয় হইল |”
বিমলা কহিলেন, “উঁহু, ইহার এক গোপন কথা আছে |”
প্রহরী কহিল, “কি?”
বি। তোমাকে সে কথা বলিয়া দিই, যদি তুমি কোনরূপে দুর্গজয় করাইতে পার।
প্রহরী হাঁ করিয়া শুনিতে লাগিল; বিমলা কথা বলিতে সঙ্কোচ করিতে লাগিলেন। প্রহরী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “ব্যাপার কি?”
বিমলা কহিলেন, “তোমরা জান না, এই দুর্গপার্শ্বে জগৎসিংহ দশ সহস্র সেনা লইয়া বসিয়া আছে। তোমরা আজ গোপনে আসিবে জানিয়া, সে আগে বসিয়া আছে; এখন কিছু করিবে না, তোমরা দুর্গজয় করিয়া এখন নিশ্চিন্ত থাকিবে, তখন আসিয়া ঘেরাও করিবে |”
প্রহরী ক্ষণকাল অবাক হইয়া রহিল; পরে বলিল, “সে কি?”
বি। এই কথা, দুর্গস্থ সকলেই জানে; আমরাও শুনিয়াছি।
প্রহরী আহ্লাদে পরিপূর্ণ হইয়া কহিল, “জান্! আজ তুমি আমাকে বড়লোক করিলে; আমি এখনই গিয়া সেনাপতিকে বলিয়া আসি, এমন জরুরি খবর দিলে শিরোপা পাইব, তুমি এইখানে বসো, আমি শীঘ্র আসিতেছি |”
প্রহরীর মনে বিমলার প্রতি তিলার্ধ সন্দেহ ছিল না।
বিমলা বলিলেন, “তুমি আসিবে ত?”
প্র। আসিব বই কি, এই আসিলাম।
বি। আমাকে ভুলিবে না?
প্র। না – না।
বি। দেখ, মথা খাও।
“চিন্তা কি?” বলিয়া প্রহরী ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া গেল।
যেই প্রহরী অদৃশ্য হইল, অমনি বিমলাও উঠিয়া পলাইলেন। ওসমানের কথা যথার্থ, “বিমলার কটাক্ষকেই ভয় |”