বিষবৃক্ষ
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : সূর্যমুখী ও কমলমণি
যখন প্রদোষে, উভয়ে উভয়ের নিকট স্পষ্ট করিয়া কথা কহিতে সমর্থ হইলেন, তখন সূর্যমুখী কমলমণির কাছে নগেন্দ্র ও কুন্দনন্দিনীর বিবাহবৃত্তান্তের আমূল পরিচয় দিলেন। শুনিয়া কমলমণি বিস্মিতা হইয়া বলিলেন, “এ বিবাহ তোমার যত্নেই হইয়াছে–কেন তুমি আপনার মৃত্যুর উদ্যোগ আপনি করিলে?”
সূর্যমুখী হাসিয়া বলিলেন, “আমি কে?”–মৃদু ক্ষীণ হাসিয়া হাসিয়া উত্তর করিলেন,- বৃষ্টির পর আকাশপ্রান্ত ছিন্ন মেঘে যেমন বিদ্যুৎ হয়, সেইরূপ হাসি হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আমি কে? একবার তোমার ভাইকে দেখিয়া আইস–সে মুখভরা আহ্লাদ দেখিয়া আইস;-তখন জানিবে, তিনি আজ কত সুখে সুখী। তাঁহার এত সুখ আমি চক্ষে দেখিলাম, তবে কি আমার জীবন সার্থক হইল না? কোন্ সুখের আশায় তাঁকে অসুখী রাখিব? যাঁহার এক দণ্ডের অসুখ দেখিলে মরিতে ইচ্ছা করে, দেখিলাম, দিবারাত্র তাঁর মর্মান্তিক অসুখ–তিনি সকল সুখ বিসর্জন দিয়া দেশত্যাগী হইবার উদ্যোগ করিলেন–তবে আমার সুখ কি রহিল? বলিলাম, “প্রভু! তোমার সুখই আমার সুখ–তুমি কুন্দকে বিবাহ কর–আমি সুখী হইব’,-তাই বিবাহ করিয়াছেন |”
ক। আর, তুমি সুখী হইয়াছ?
সূ। আবার আমার কথা কেন জিজ্ঞাসা কর, আমি কে? যদি কখনও স্বামীর পায়ে কাঁকর ফুটিয়াছে দেখিয়াছি, তখনই মনে হইয়াছে যে, আমি ঐখানে বুক পাতিয়া দিই নাই কেন, স্বামী আমার বুকের উপর পা রাখিয়া যাইতেন।
বলিয়া সূর্যমুখী ক্ষণকাল নীরবে রহিলেন–তাঁহার চক্ষের জলে বসন ভিজিয়া গেল–পরে সহসা মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কমল, কোন্ দেশে মেয়ে হলে মেরে ফেলে?”
কমল মনের ভাব বুঝিয়া বলিলেন, “মেয়ে হলেই কি হয়? যার যেমন কপাল, তার তেমনি ঘটে |”
সূ। আমার কপালের চেয়ে কার কপাল ভাল? কে এমন ভাগ্যবতী? কে এমন স্বামী পেয়েছে? রূপ, ঐশ্বর্য, সম্পদ–সে সকলও তুচ্ছ কথা–এত গুণ কার স্বামীর? আমার কপাল, জোর কপাল–তবে কেন এমন হইল?
ক। এও কপাল।
সূ। তবে এ জ্বালায় মন পোড়ে কেন?
ক। তুমি স্বামীর আজিকার আহ্লাদপূর্ণ মুখ দেখিয়া সুখী–তথাপি বলিতেছ, এ জ্বালায় মন পোড়ে কেন? দুই কথাই কি সত্য?
সূ। দুই কথাই সত্য। আমি তাঁর সুখে সুখী–কিন্তু আমায় যে তিনি পায়ে ঠেলিলেন, আমার পায়ে ঠেলিয়াছেন বলিয়াই তাঁর এত আহ্লাদ!–
সূর্যমুখী আর বলিতে পারিলেন না, কণ্ঠ রুদ্ধ হইল–চক্ষু ভাসিয়া গেল, কিন্তু সূর্যমুখীর অসমাপ্ত কথার মর্ম কমলমণি সম্পূর্ণ বুঝিয়াছিলেন। বলিলেন, “তোমায় পায়ে ঠেলেছেন বলে তোমার অন্তর্দাহ হতেছে। তবে কেন বল আমি কে? তোমার অন্ত:করণের আধখানা আজও আমিতে ভরা; নহিলে আত্মবিসর্জন করিয়াও অনুতাপ করিবে কেন?”
সূ। অনুতাপ করি না। ভালই করিয়াছি, ইহাতে আমার কোন কোন সংশয় নাই। কিন্তু মরণে ত যন্ত্রণা আছেই। আমার মরণই ভাল বলিয়া, আপনার হাতে আপনি মরিলাম। কিন্তু তাই বলিয়া মরণের সময়ে কি তোমার কাছে কাঁদিব না?