ব্রাহ্মণ পুনর্বার বিমলার পৃষ্ঠের নিকট আসিয়া অঞ্চল ধরিয়াছেন; বিমলা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আবার কি?”

ব্রাহ্মণ অস্ফুট স্বরে কহিলেন, “সে কত দূর?”

বি। কি কত দূর?

দি। সেই বটগাছ?

বি। কোন্ বটগাছ?

দি। যেখানে তোমরা সেদিন দেখেছিলে?

বি। কি দেখেছিলাম?

দি। রাত্রিকালে নাম করিতে নাই।

বিমলা বুঝিতে পারিয়া সুযোগ পাইলেন।

গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “ই:।”

ব্রাহ্মণ অধিকতর ভীত হইয়া কহিলেন, “কি গা?”

বিমলা অস্ফুট স্বরে শৈলেশ্বরনিকটস্থ বটবৃক্ষের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন “সে ঐ বটতলা |”

দিগ্গবজ আর নড়িলেন না; গতিশক্তিরহিত, অশ্বত্থপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিলেন।

বিমলা বলিলেন, “আইস |”

ব্রাহ্মণ কাঁপিতে কাঁপিতে কহিলেন, “আমি আর যাইতে পারিব না |”

বিমলা কহিলেন, “আমারও ভয় করিতেছে |”

ব্রাহ্মণ এই শুনিয়া পা ফিরাইয়া পলায়নোদ্যত হইলেন।

বিমলা বৃক্ষপানে দৃষ্টি করিয়া দেখিলেন, বৃক্ষমূলে একটা ধবলাকার কি পদার্থ রহিয়াছে। তিনি জানিতেন যে, বৃক্ষমূলে শৈলেশ্বরের ষাঁড় শুইয়া থাকে; কিন্তু গজপতিকে কহিলেন “গজপতি! ইষ্টদেবের নাম জপ; বৃক্ষমূলে কি দেখিতেছ?”

“ও গো – বাবা গো___” বলিয়াই দিগ্গ জ একবারে চম্পট। দীর্ঘ দীর্ঘ চরণ – তিলার্ধ মধ্যে অর্ধ ক্রোশ পার হইয়া গেলেন।

বিমলা গজপতির স্বভাব জানিতেন; অতএব বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, তিনি একেবারে দুর্গ-দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইবেন।

বিমলা তখন নিশ্চিন্ত হইয়া মন্দিরাভিমুখে চলিলেন।

বিমলা সকল দিক ভাবিয়া আসিয়াছিলেন, কেবল একদিক ভাবিয়া আইসেন নাই; রাজপুত্র মন্দিরে আসিয়াছেন কি? মনে এইরূপ সন্দেহ জন্মিলে বিমলার বিষম ক্লেশ হইল। মনে করিয়া দেখিলেন যে, রাজপুত্র আসার নিশ্চিত কথা কিছুই বলেন নাই; কেবল বলিয়াছিলেন যে, “এইখানে আমার সাক্ষাৎ পাইবে, এখানে না দেখা পাও, তবে সাক্ষাৎ হইল না |” তবে ত না আসারও সম্ভাবনা।

যদি না আসিয়া থাকেন, তবে এত ক্লেশ বৃথা হইল। বিমলা বিষণ্ণ হইয়া আপনা আপনি কহিতে লাগিলেন যে, “এ কথা আগে কেন ভাবি নাই? ব্রাহ্মণকেই বা কেন তাড়াইলাম? একাকিনী এ রাত্রে কি প্রকারে ফিরিয়া যাইব! শৈলেশ্বর! তোমার ইচ্ছা!”