হী। আমার মাহিনা পত্র হিসাব করিয়া দিতে হুকুম করুন।

ন। (সবিস্ময়ে) সে কি? কি হয়েছে?

হী। আমার জবাব হয়েছে। মা ঠাকুরাণী আমাকে জবাব দিয়াছেন।

ন। কি করেছিস তুই?

হী। কুশি আমাকে গালি দিয়াছিল–আমি নালিশ করিয়াছিলাম। তিনি তার কথায় বিশ্বাস করিয়া আমাকে জবাব দিলেন।

নগেন্দ্র মাথা নাড়িয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “সে কাজের কথা নয়, হীরে, আসল কথা কি বল।”

হীরা তখন ঋজু হইয়া বলিল, “আসল কথা, আমি থাকিব না |”

ন। কেন?

হী। মা ঠাকুরাণীর মুখ বড় এলোমেলো হয়েছে–কারে কখন কি বলেন, ঠিক নাই।

নগেন্দ্র ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া তীব্রস্বরে বলিলেন, “সে কি?”

হীরা যাহা বলিতে আসিয়াছিল, তাহা এইবার বলিল, “সেদিন কুন্দঠাকুরাণীকে কি না বলিয়াছিলেন। শুনিয়া কুন্দঠাকুরাণী দেশত্যাগী হইয়াছেন। আমাদের ভয়, পাছে আমাদের সেইরূপ কোন্ দিন কি বলেন,-আমরা তা হলে বাঁচিব না। তাই আগে হইতে সরিতেছি।”

ন। সে কি কথা?

হী। আপনার সাক্ষাতে লজ্জায় তা আমি বলিতে পারি না।

শুনিয়া, নগেন্দ্রের ললাট অন্ধকার হইল। তিনি হীরাকে বলিলেন, “আজ বাড়ী যা। কাল ডাকাব |”

হীরার মনস্কাম সিদ্ধ হইল। সে এইজন্য কৌশল্যার সঙ্গে বচসা সৃজন করিয়াছিল।

নগেন্দ্র উঠিয়া সূর্যমুখীর নিকটে গেলেন। হীরা পা টিপিয়া টিপিয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ গেল।

সূর্যমুখীকে নিভৃতে লইয়া গিয়া নগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি হীরাকে বিদায় দিয়াছ?” সূর্যমুখী বলিলেন, “দিয়াছি |” অনন্তর হীরা ও কৌশল্যার বৃত্তান্ত সবিশেষ বিবৃত করিলেন। শুনিয়া নগেন্দ্র বলিলেন, “মরুক। তুমি কুন্দনন্দিনীকে কি বলিয়াছিলে?”

নগেন্দ্র দেখিলেন, সূর্যমুখীর মুখ শুকাইল। সূর্যমুখী অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “কি বলিয়াছিলাম?”

ন॥ কোন দুর্বাক্য?

সূর্যমুখী কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। পরে যাহা বলা উচিৎ, তাহাই বলিলেন, বলিলেন, “তুমি আমার সর্বস্ব। তুমি আমার ইহকাল, তুমি আমার পরকাল। তোমার কাছে কেন আমি লুকাইব? কখনও কোন কথা তোমার কাছে লুকাই নাই, আজ কেন একজন পরের কথা তোমার কাছে লুকাইব? আমি কুন্দকে কুকথা বলিয়াছিলাম। পাছে তুমি রাগ কর বলিয়া তোমার কাছে ভরসা করিয়া বলি নাই। অপরাধ মার্জনা করিও। আমি সকল কথা বলিতেছি |”

তখন সূর্যমুখী হরিদাসী বৈষ্ণবীর পরিচয় হইতে কুন্দনন্দিনীর তিরস্কার পর্যন্ত অকপটে সকল বিবৃত করিলেন। বলিয়া, শেষ কহিলেন, “আমি কুন্দনন্দিনীকে তাড়াইয়া আপনার মরমে আপনি মরিয়া আছি। দেশে দেশে তাহার তত্ত্বে লোক পাঠাইয়াছি। যদি সন্ধান পাইতাম, ফিরাইয়া আনিতাম। আমার অপরাধ লইও না |”

নগেন্দ্র তখন বলিলেন, “তোমার বিশেষ অপরাধ নাই, তুমি যেরূপ কুন্দের কলঙ্ক শুনিয়াছিলে, তাহাতে কোন্ ভদ্রলোকের স্ত্রী তাকে মিষ্ট কথা বলিবে, কি ঘরে স্থান দিবে? কিন্তু একবার ভাবিলে ভাল হইত যে, কথাটা সত্য কি না?”