ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : হীরার রাগ

হীরার বাড়ী প্রাচীর আঁটা। দুইটি ঝরঝরে মেটে ঘর। তাহাতে আলেপনা–পদ্ম আঁকা–পাখী আঁকা–ঠাকুর আঁকা। উঠান নিকান–এক পাশে রাঙ্গা শাক, তার কাছে দোপাটি, মল্লিকা, গোলাপ ফুল। বাবুর বাড়ীর মালী আপনি আসিয়া চারা আনিয়া ফুলগাছ পুতিয়া দিয়া গিয়াছিল–‍‍হীরা চাহিলে, চাই কি বাগান শুদ্ধই উহার বাড়ী তুলিয়া দিয়া যায়। মালীর লাভের মধ্যে এই, হীরা আপন হাতে তামাকু সাজিয়া দেয়। হীরা, কালো-চুড়ি পরা হাতখানিতে হুঁকা ধরিয়া মালীর হাতে দেয়, মালী বাড়ী গিয়া রাত্রে তাই ভাবে।

হীরার বাড়ী হীরার আয়ি থাকে, আর হীরা। এক ঘরে আয়ি, এক ঘরে হীরা শোয়। হীরা কুন্দকে আপনার কাছে বিছানা করিয়া রাত্রে শুয়াইল। কুন্দ শুইল–ঘুমাইল না। পরদিন তাহাকে সেইখানে রাখিল। বলিল, “আজি কালি দুই দিন থাক; দেখ, রাগ না পড়ে, পরে যেখানে ইচ্ছা, সেইখানে যাইও |” কুন্দ রহিল। কুন্দের ইচ্ছানুসারে তাহাকে লুকাইয়া রাখিল। ঘরে চাবি দিল, আয়ি না দেখে। পরে বাবুর বাড়ীতে কাজে গেল। দুই প্রহর বেলায় আয়ি যখন স্নানে যায়, হীরা তখন আসিয়া কুন্দকে স্নানাহার করাইল। আবার চাবি দিয়া চলিয়া গেল। রাত্রে আসিয়া চাবি খুলিয়া উভয়ে শয্যা রচনা করিল।

“টিট্–কিট্–খিট্–খিটি–খাট্” বাহির দুয়ারের শিকল সাবধানে নড়িল। হীরা বিস্মিত হইল। একজনমাত্র কখনও কখনও রাত্রে শিকল নাড়ে। সে বাবুর বাড়ীর দ্বারবান, রাত ভিত ডাকিতে আসিয়া শিকল নাড়ে। কিন্তু তাহার হাতে শিকল অমন মধুর বলে না, তাহার হাতে শিকল নাড়িলে, বলে, “কট কট কটা:, তোর মাথা মুণ্ড উঠা! কড়্ কড়্ কড়াং! খিল খোল নয় ভাঙ্গি ঠ্যাং|” তা ত শিকল বলিল না। এ শিকল বলিতেছে, “কিট্ কিট্ কিটী! দেখি কেমন আর হীরেটি! খিট খাট্ ছন্! উঠল আমার হীরামন! ঠিট্ ঠিট্ ঠিঠি ঠিনিক্–আয় রে আমার হীরা মাণিক|” হীরা উঠিয়া দেখিতে গেল ; বাহির দুয়ার খুলিয়া দেখিল, স্ত্রীলোক। প্রথমে চিনিতে পারিল না, পরেই চিনিল–“কে ও গঙ্গাজল! এ কি ভাগ্য!” হীরার গঙ্গাজল মালতী গোয়ালিনী। মালতী গোয়ালিনীর বাড়ী দেবীপুর–দেবেন্দ্র বাবুর বাড়ীর কাছে–বড় রসিকা স্ত্রীলোক। বয়স বৎসর ত্রিশ বত্রিশ, সাড়ী পরা, হাতে রুলি, মুখে পানের রাগ। মালতী গোয়ালিনী প্রায় গৌরাঙ্গী– একটু রৌদ্র পোড়া–মুখে রাঙ্গা রাঙ্গা দাগ, নাক খাঁদা–কপালে উল্কি। কসে তামাকুপোড়া টেপা আছে। মালতী গোয়ালিনী দেবেন্দ্র বাবুর দাসী নহে–আশ্রিতাও নহে–অথচ তাঁহার বড় অনুগত–অনেক ফরমায়েশ–যাহা অন্যের অসাধ্য, তাহা মালতী সিদ্ধ করে। মালতীকে দেখিয়া চতুরা হীরা বলিল, “ভাই গঙ্গাজল! অন্তিম কালে যেন তোমায় পাই! কিন্তু এখন কেন?”

গঙ্গাজল চুপি চুপি বলিল, “তোকে দেবেন্দ্র বাবু ডেকেছে|”

হীরা কাদা মাখে, হাসিয়া বলিল, “তুই কিছু পাবি নাকি?”

মালতী দুই অঙ্গুলের দ্বারা হীরাকে মারিল, বলিল, “মরণ আর কি! তোর মনের কথা তুই জানিস! এখন চ!”

হীরা ইহাই চায়। কুন্দকে বলিল, “আমার বাবুর বাড়ী যেতে হলো–ডাকিতে এসেছে‌! কে জানে কেন?” বলিয়া প্রদীপ নিবাইল এবং অন্ধকারে কৌশলে বেশভূষা করিয়া মালতীর সঙ্গে যাত্রা করিল। দুই জনে অন্ধকারে গলা মিলাইয়া–

 

“মনের মতন রতন পেলে যতন করি তায়

সাগর ছেঁচে তুলবো নাগর পতন করে কায় ;”

 

ইতি গীত গায়িতে গায়িতে চলিল।