সু। তবে যাও কেন?

দে। কেবল তাহাকে দেখিবার জন্য। তাহাকে দেখিয়া, তাহার সঙ্গে কথা কহিয়া, তাহাকে গান শুনাইয়া যে কি পর্যন্ত তৃপ্তি হয়, তাহা বলিতে পারি না।

সু। তোমাকে আমি সত্য বলিতেছি–উপহাস করিতেছি না। তুমি যদি এই দুষ্প্রবৃত্তি ত্যাগ না করিবে–তুমি যদি সে পথে আর যাইবে–তবে আমার সঙ্গে তোমার আলাপ এই পর্যন্ত বন্ধ। আমিও তোমার শত্রু হইব।

দে। তুমি আমার একমাত্র সুহৃদ। আমি অর্ধেক বিষয় ছাড়িতে পারি, তবু তোমাকে ছাড়িতে পারি না। কিন্তু তোমাকে যদি ছাড়িতে হয়, সেও স্বীকার, তবু আমি কুন্দনন্দিনীকে দেখিবার আশা ছাড়িতে পারিব না।

সু। তবে তাহাই হউক। তোমার সঙ্গে আমার এই পর্যন্ত সাক্ষাৎ।

এই বলিয়া সুরেন্দ্র দু:খিত চিত্তে উঠিয়া গেলেন। দেবেন্দ্র একমাত্র বন্ধুবিচ্ছেদে অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হইয়া কিয়ৎকাল বিমর্ষভাবে বসিয়া রহিলেন। শেষ, ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিলেন, “দূর হউক! এ সংসারে কে কার! আমিই আমার!” এই বলিয়া পাত্র পূর্ণ করিয়া ব্রাণ্ডি পান করিলেন। তাহার বশে আশু চিত্তপ্রফুল্লতা জন্মিল। তখন দেবেন্দ্র, শুইয়া পড়িয়া চক্ষু মুদিয়া গান ধরিলেন,

“আমার নাম হীরা মালিনী।

আমি থাকি রাধার কুঞ্জে, কুব্জা আমার ননদিনী।

রাবণ বলে চন্দ্রাবলি,

তুমি আমার কমল কলি,

শুনে কীচক মেরে কৃষ্ণ,

উদ্ধারিল যাজ্ঞসেনী!”

তখন পারিষদেরা সকলে উঠিয়া গিয়াছিল, দেবেন্দ্র নৌকাশূন্য নদীবক্ষ:স্থিত ভেলার ন্যায় একা বসিয়া রসের তরঙ্গে হাবুডুবু খাইতেছিলেন। রোগরূপ তিমি মকরাদি এখন জলের ভিতর লুকাইয়াছিল–এখন কেবল মন্দ পবন আর চাঁদের আলো! এমন সময়ে জানালার দিকে কি একটা খড় খড় শব্দ হইল–কে যেন খড়খড়ি তুলিয়া দেখিতেছিল–হঠাৎ ফেলিয়া দিল। দেবেন্দ্র বোধ হয়, মনে মনে কাহারও প্রতীক্ষা করিতেছিলেন–বলিলেন, “কে খড়খড়ি চুরি করে?” কোন উত্তর না পাইয়া জানেলা দিয়া দেখিলেন– দেখিতে পাইলেন, এক জন স্ত্রীলোক পলায়। স্ত্রীলোক পলায় দেখিয়া দেবেন্দ্র জানেলা খুলিয়া লাফাইয়া পড়িয়া, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ টলিতে টলিতে ছুটিলেন।

স্ত্রীলোক অনায়াসে পলাইলে পলাইতে পারিত, কিন্তু ইচ্ছাপূর্বক পলাইল না, কি অন্ধকারে ফুলবাগানের মাঝে পথ হারাইল, তাহা বলা যায় না। দেবেন্দ্র তাহাকে ধরিয়া অন্ধকারে তাহার মুখপানে চাহিয়া চিনিতে পারিলেন না। চুপি চুপি মদের ঝোঁকে বলিলেন, “বাবা! কোন্ গাছ থেকে?” পরে তাহাকে ঘরের ভিতর টানিয়া আনিয়া একবার এক দিকে আবার আর এক দিকে আলো ধরিয়া দেখিয়া, সেইরূপ স্বরে বলিলনে, “তুমি কাদের পেত্নী গা?” শেষে কিছু স্থির করিতে না পারিয়া বলিলেন, “পারলেম না বাপ! আজ ফিরে যাও, অমাবস্যায় লুচি পাঁঠা দিয়ে পূজো দেব–আজ একটু কেবল ব্রাণ্ডি খেয়ে যাও,” এই বলিয়া মদ্যপ স্ত্রীলোকটিকে বৈঠকখানায় বসাইয়া, মদের গেলাস তাহার হাতে দিল।

স্ত্রীলোকটি তাহা গ্রহণ না করিয়া নামাইয়া রাখিল।

তখন মাতাল আলোটা স্ত্রীলোকের মুখের কাছে লইয়া গেল। এদিক ওদিক চারিদিক আলোটা ফিরাইয়া ফিরাইয়া গম্ভীরভাবে তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া, শেষ হঠাৎ আলোটা ফেলিয়া দিয়া গান ধরিল,-“তুমি কে বট হে, তোমায় চেন চেন করি–কোথাও দেখেছি হে|”