কুন্দ তখন দুই চক্ষে হাত দিয়া কাঁদিতে লাগিল। সহসা অন্ধকার গৃহে প্রদীপ জ্বালার ন্যায়, কুন্দের সেই স্বপ্ন-বৃত্তান্ত সুস্পষ্ট মনে পড়িল। কুন্দ তখন বিদ্যুৎস্পৃষ্টার ন্যায় গাত্রোত্থান করিল। “আমি সকল ভুলিয়া গিয়াছি–আমি কেন ভুলিলাম? মা আমাকে দেখা দিয়াছিলেন–মা আমার কপালের লিখন জানিতে পারিয়া আমায় ঐ নক্ষত্রলোকে যাইতে বলিয়াছিলেন–আমি কেন তাঁর কথা শুনলেম না–আমি কেন গেলাম না! –আমি কেন মলেম না! আমি এখনও বিলম্ব করিতেছি কেন? আমি এখনও মরিতেছি না কেন? আমি এখনই মরিব |” এই ভাবিয়া কুন্দ ধীরে ধীরে সেই সরোবরসোপান অবতরণ আরম্ভ করিল। কুন্দ নিতান্ত অবলা–নিতান্ত ভীরুস্বভাবসম্পন্না–প্রতি পদার্পণে ভয় পাইতেছিল–প্রতি পদার্পণে তাহার অঙ্গ শিহরিতেছিল। তথাপি অস্খলিতসঙ্কল্পে সে মাতার আজ্ঞাপালনার্থে ধীরে ধীরে যাইতেছিল। এমত সময় পশ্চাৎ হইতে কে অতি ধীরে ধীরে তাহার পৃষ্ঠে অঙ্গুলিস্পর্শ করিল। বলিল, “কুন্দ!” কুন্দ দেখিল–সে অন্ধকারে দেখিবামাত্র চিনিল–নগেন্দ্র। কুন্দের সে দিন আর মরা হলো না।

আর নগেন্দ্র! এই কি তোমার এত কালের সুচরিত্র? এই কি তোমার এত কালের শিক্ষা? এই কি সূর্যমুখীর প্রাণপণ প্রণয়ের প্রতিফল! ছি ছি! দেখ, তুমি চোর! চোরের অপেক্ষাও হীন। চোর সূর্যমুখীর কি করিত? তাহার গহনা চুরি করিত, অর্থহানি করিত, কিন্তু তুমি তাহার প্রাণহানি করিতে আসিয়াছ। চোরকে সূর্যমুখী কখন কিছু দেয় নাই ; তবু সে চুরি করিলে চোর হয়। আর সূর্যমুখী তোমাকে সর্বস্ব দিয়াছে–তবু তুমি চোরের অধিক চুরি করিতে আসিয়াছ! নগেন্দ্র, তুমি মরিলেই ভাল হয়। যদি সাহস থাকে, তবে তুমি গিয়া ডুবিয়া মর।

আর ছি! ছি! কুন্দনন্দিনি! তুমি চোরের স্পর্শে কাঁপিলে কেন? ছি! ছি! কুন্দনন্দিনী!–চোরের কথা শুনিয়া তোমার গায়ে কাঁটা দিল কেন? কুন্দনন্দিনী!–দেখ, পুষ্করিণীর জল পরিষ্কার, সুশীতল, সুবাসিত–বায়ূ তাহার নীচে তারা কাঁপিতেছে। ডুবিবে? ডুবিয়া মর না? কুন্দনন্দিনী মরিতে চাহে না।

চোর বলিল, “কুন্দ। কলিকাতায় যাইবে?”

কুন্দ কথা কহিল না–চক্ষু মুছিল–কথা কহিল না।

চোর বলিল, “কুন্দ! ইচ্ছাপূর্বক যাইতেছ?”

ইচ্ছাপূর্বক! হরি! হরি‌‌! কুন্দ আবার চক্ষু মুছিল–কথা কহিল না।

“কুন্দ–কাঁদিতেছ কেন?” কুন্দ এবার কাঁদিয়া ফেলিল। তখন নগেন্দ্র বলিতে লাগিলেন, “শুন কুন্দ! আমি বহু কষ্টে এত দিন সহ্য করিয়াছিলাম. কিন্তু আর পারিলাম না। কি কষ্টে যে বাঁচিয়া আছি, তাহা বলিতে পারি না। আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আপনি ক্ষত বিক্ষত হইয়াছি। ইতর হইয়াছি, মদ খাই। আর পারি না। তোমাকে ছাড়িয়া দিতে পারি না। শুন, কুন্দ! এখন বিধবাবিবাহ চলিত হইতেছে– আমি তোমাকে বিবাহ করিব। তুমি বলিলেই বিবাহ করি |”

কুন্দ এবার কথা কহিল। বলিল, “না |”

আবার নগেন্দ্র বলিলেন, “কেন কুন্দ! বিধবার বিবাহ কি অশাস্ত্র?” কুন্দ আবার বলিল, “না|”

নগেন্দ্র বলিল, “তবে না কেন? বল বল-বল–আমার গৃহিণী হইবে কি না? আমায় ভালবাসিবে কি না?”

কুন্দ বলিল, “না |”

তখন নগেন্দ্র যেন সহস্রমুখে অপরিমিত প্রেমপরিপূর্ণ মর্মভেদী কত কথা বলিলেন। কুন্দ বলিল “না |”

তখন নগেন্দ্র চাহিয়া দেখিলেন, পুষ্করিণী নির্মল, সুশীতল–কুসুম-বাস-সুবাসিত–পবনহিল্লোলে তন্মধ্যে তারা কাঁপিতেছে,-ভাবিলেন, “উহার মধ্যে শয়ন কেমন?”

অন্তরীক্ষে যেন কুন্দ বলিতে লাগিল, “না |” বিধবার বিবাহ শাস্ত্র আছে। তাহার জন্য নয়। তবে কুন্দ ডুবিয়া মরিল না কেন? স্বচ্ছ বারি–শীতল জল–নীচে নক্ষত্র নাচিতেছে–কুন্দ ডুবিয়া মরিল না কেন?