অভিরাম স্বামী বিষণ্ণ হইয়া নীরব হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি পাঠানের সহায়তা করা তোমার শ্রেয়ঃ হইল?”

বীরেন্দ্র উত্তর করিলেন, “পক্ষাপক্ষ প্রভেদ করা কি শ্রেয়ঃ।”

অ। হাঁ, পক্ষাপক্ষ প্রভেদ করা শ্রেয়ঃ।

বী। তবে আমার পাঠান-সহকারী হওয়া শ্রেয়ঃ।

অভিরাম স্বামী দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া পুনরায় নীরব হইলেন; চক্ষে তাঁহার বারিবিন্দু উপস্থিত হইল। দেখিয়া বীরেন্দ্রসিংহ যৎপরোনাস্তি বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, “গুরো! ক্ষমা করুন; আমি না জানিয়া কি অপরাধ করিলাম আজ্ঞা করুন।”
অভিরাম স্বামী উত্তরীয় বস্ত্রে চক্ষু পরিষ্কার করিয়া কহিলেন, “শ্রবণ কর, আমি কয়েক দিবস পর্যন্ত জ্যোতিষী-গণনায় নিযুক্ত আছি, তোমা অপেক্ষা তোমার কন্যা আমার স্নেহের পাত্রী, ইহা তুমি অবগত আছ; স্বভাবতঃ তৎসম্বন্ধেই বহুবিধ গণনা করিলাম |” বীরেন্দ্রসিংহের মুখ বিশুষ্ক হইল; আগ্রহ সহকারে পরমহংসকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “গণনায় কি দেখিলেন?” পরমহংস কহিলেন, “দেখিলাম যে মোগল সেনাপতি হইতে তিলোত্তমার মহৎ অমঙ্গল |” বীরেন্দ্রসিংহের মুখ কৃষ্ণবর্ণ হইল। অভিরাম স্বামী কহিতে লাগিলেন, “মোগলেরা বিপক্ষ হইলেই তৎকর্তৃক তিলোত্তমার অমঙ্গল সম্ভবে; স্বপক্ষ হইলে সম্ভবে না, এজন্যই আমি তোমাকে মোগল পক্ষে প্রবৃত্তি লওয়াইতেছিলাম। এই কথা ব্যক্ত করিয়া তোমাকে মনঃপীড়া দিতে আমার ইচ্ছা ছিল না; মনুষ্যযত্ন বিফল; বুঝি ললাটলিপি অবশ্য ঘটিবে, নহিলে তুমি এত স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইবে কেন?”
বীরেন্দ্রসিংহ মৌন হইয়া থাকিলেন। অভিরাম স্বামী কহিলেন, “বীরেন্দ্র, দ্বারে কতলু খাঁর দূত দণ্ডায়মান; আমি তাহাকে দেখিয়াই তোমার নিকট আসিয়াছি, আমার নিষেধক্রমেই দৌবারিকেরা এ পর্যন্ত তাহাকে তোমার সম্মুখে আসিতে দেয় নাই। এক্ষণে আমার বক্তব্য সমাপন হইয়াছে, দূতকে আহ্বান করিয়া উচিত প্রত্যুত্তর দাও|” বীরেন্দ্রসিংহ নিশ্বাসসহকারে মস্তকোত্তলন করিয়া কহিলেন, “গুরুদেব! যতদিন তিলোত্তমাকে না দেখিয়াছিলাম, ততদিন কন্যা বলিয়া তাহাকে স্মরণও করিতাম না; এক্ষণে তিলোত্তমা ব্যতীত আর আমার সংসারে কেহই নাই; আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য করিলাম; অদ্যাবধি ভূতপূর্ব বিসর্জন দিলাম; মানসিংহের অনুগামী হইব; দৌবারিক দূতকে আনয়ন করুক |”

আজ্ঞাতে দৌবারিক দূতকে আনয়ন করিল। দূত কতলু খাঁর পত্র প্রদান করিল। পত্রের মর্ম এই যে, বীরেন্দ্রসিংহ এক সহস্র অশ্বারোহী সেনা আর পঞ্চ সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাঠানশিবিরে প্রেরণ করুন, নচেৎ কতলু খাঁ বিংশতি সহস্র সেনা গড় মান্দারণে প্রেরণ করিবেন।

বীরেন্দ্রসিংহ পত্র পাঠ করিয়া কহিলেন, “দূত! তোমার প্রভুকে কহিও, তিনিই সেনা প্রেরণ করুন |” দূত নতশির হইয়া প্রস্থান করিল।

সকল কথা অন্তরালে থাকিয়া বিমলা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিলেন।