কুন্দ সরলা হইলেও, বুঝিল যে, সে শাশুড়ীর সঙ্গে সম্বন্ধ স্বীকারই অকর্তব্য। অতএব বৈষ্ণবীর কথায় কেবল ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিল।

কিন্তু বৈষ্ণবী ছাড়ে না–পুন:পুন: উত্তেজনা করিতে লাগিল। তখন কুন্দ কহিল, “আমি গিন্নীকে না বলিয়া যাইতে পারিব না |”

হরিদাসী মানা করিল। বলিল, “গিন্নীকে বলিও না। যাইতে দিবে না। হয়ত তোমার শাশুড়ীকে আনিতে পাঠাইবে। তাহা হইলে তোমার শাশুড়ী দেশছাড়া হইয়া পালাইবে |”

বৈষ্ণবী যতই দার্ঢ্য প্রকাশ করুক, কুন্দ কিছুতেই সূর্যমুখীর অনুমতি ব্যতীত যাইতে সম্মত হইল না। তখন অগত্যা হরিদাসী বলিল, “আচ্ছা তবে তুমি গিন্নীকে ভাল করিয়া বলিয়া রেখ। আমি আর একদিন আসিয়া লইয়া যাইব; কিন্তু দেখো, ভাল করিয়া বলো; আর একটু কাঁদাকাটা করিও, নহিলে হইবে না |”

কুন্দ ইহাতে স্বীকৃত হইল না, কিন্তু বৈষ্ণবীকে হাঁ কি না, কিছু বলিল না। তখন হরিদাসী হস্তমুখপ্রক্ষালন সমাপ্ত করিয়া অন্য সকলের কাছে ফিরিয়া আসিয়া পুরস্কার চাহিল। এমত সময়ে সেইখানে সূর্যমুখী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন বাজে কথা একেবারে বন্ধ হইল, অল্পবয়স্কারা সকলেই একটা একটা কাজ লইয়া বসিল।

সূর্যমুখী হরিদাসীকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “তুমি কে গা?” তখন নগেন্দ্রের এক মামী কহিলেন, “ও একজন বৈষ্ণবী, গান করিতে এসেছে। গান যে সুন্দর গায়! এমন গান কখন শুনিনে মা। তুমি একটি শুনিবে? গা ত গা হরিদাসী! একটি ঠাকরুণ বিষয় গা |”

হরিদাসী এক অপূর্ব শ্যামাবিষয় গাইলে সূর্যমুখী তাহাতে মোহিতা ও প্রীতা হইয়া বৈষ্ণবীকে পুরস্কারপূর্বক বিদায় করিলেন।

বৈষ্ণবী প্রণাম করিয়া এবং কুন্দের প্রতি আর একবার দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া বিদায় লইল। সূর্যমুখী চক্ষের আড়ালে গেলেই সে খঞ্জনীতে মৃদু মৃদু খেমটা বাজাইয়া মৃদু মৃদু গাইতে গাইতে গেল,

 

“আয় রে চাঁদের কণা।

তোরে খেতে দিব ফুলের মধু, পরতে দিব সোণা।

আতর দিব শিশি ভরে,

গোলাপ দিব কার্বা করে,

আর আপনি সেজে বাটা ভরে,

দিব পানের দোনা।”

 

বৈষ্ণবী গেলে স্ত্রীলোকেরা অনেকক্ষণ কেবল বৈষ্ণবীর প্রসঙ্গ লইয়াই রহিল। প্রথমে তাহার বড় সুখ্যাতি আরম্ভ হইল। পরে ক্রমে একটু খুঁত বাহির হইতে লাগিল। বিরাজ বলিল, “তা হৌক, কিন্তু নাকটা একটু চাপা |” তখন বামা বলিল, “রঙটা বাপু বড় ফেঁকাসে |” তখন চন্দ্রমুখী বলিল, “চুলগুলো যেন শণের দড়ি |” তখন চাঁপা বলিল, “কপালটা একটু উঁচু |” কমলা বলিল, “ঠোঁট দুখানা পুরু |” হারাণী বলিল, “গড়নটা বড় কাট কাট |” প্রমদা বলিল, “মাগীর বুকের কাছটা যেন যাত্রার সখীদের মত; দেখে ঘৃণা করে |” এইরূপে সুন্দরী বৈষ্ণবী শীঘ্রই অদ্বিতীয় কুৎসিত বলিয়া প্রতিপন্ন হইল। তখন ললিতা বলিল, “তা দেখিতে যেমন হউক, মাগী গায় ভাল |” তাহাতেও নিস্তার নাই। চন্দ্রমুখী বলিল, “তাই বা কি, মাগীর গলা মোটা |” মুক্তকেশী বলিল, “ঠিক বলেছ–মাগী যেন ষাঁড় ডাকে |” অনঙ্গ বলিল, “মাগী গান জানে না, একটাও দাশুরায়ের গান গায়িতে পারিল না।” কনক বলিল, “মাগীর তালবোধ নাই।” ক্রমে প্রতিপন্ন হইল যে, হরিদাসী বৈষ্ণবী কেবল যে যার পর নাই কুৎসিতা, এমন নহে–তাহার গানও যার পর নাই মন্দ।