ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

এডওয়ার্ড‍স পাকা ইংরেজ। ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে তাহার লোক ছিল। শীঘ্র তাহার নিকটে খবর পৌঁছিল যে, সেই বৈষ্ণবীটা লিণ্ডলে সাহেবকে ফেলিয়া দিয়া আপনি ঘোড়ায় চড়িয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। শুনিয়াই এডওয়ার্ড‍স বলিলেন, “An imp of Satan! Strike the tents.”

তখন ঠক্ ঠক্ খটাখট তাম্বুর খোঁটায় মুগুরের ঘা পড়িতে লাগিল। মেঘরচিত অমরাবতীর ন্যায় বস্ত্রনগরী অন্তর্হিতা হইল। মাল গাড়িতে বোঝাই হইল। মানুষ ঘোড়ায় অথবা আপনার পায়ে। হিন্দু মুসলমান মাদরাজী গোরা বন্দুক ঘাড়ে মস‍্মস্ করিয়া চলিল। কামানের গাড়ি ঘড়োর ঘড়োর করিতে করিতে চলিল।

এদিকে মহেন্দ্র সন্তানসেনা লইয়া ক্রমে মেলার পথে অগ্রসর। সেই দিন বৈকালে মহেন্দ্র ভাবিল, বেলা পড়িয়া আসিল, শিবিরসংস্থাপন করা থাক।

তখন শিবিরসংস্থাপন উচিত বোধ হইল। বৈষ্ণবের তাঁবু নাই। গাছতলায় গুণ চট বা কাঁথা পাতিয়া শয়ন করে। একটু হরিচরণামৃত খাইয়া রাত্রিযাপন করে। ক্ষুধা যেটুকু বাকি থাকে, স্বপ্নে বৈষ্ণবী ঠাকুরাণীর অধরামৃত পান করিয়া পরিপূরণ করে। শিবিরোপযোগী নিকটে একটি স্থান ছিল। একটা বড় বাগান – আম কাঁটাল বাবলা তেঁতুল। মহেন্দ্র আজ্ঞা দিলেন, “এইখানেই শিবির কর |” তারই পাশে একটা টিলা ছিল, উঠিতে বড় বন্ধুর, মহেন্দ্র একবার ভাবিলেন, এ পাহাড়ের উপর শিবির করিলেও হয়। স্থানটা দেখিয়া আসিবেন মনে করিলেন।

এই ভাবিয়া মহেন্দ্র অশ্বে আরোহণ করিয়া ধীরে ধীরে টিলার উপর উঠিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি কিছু দূর উঠিলে পর যুবা যোদ্ধা বৈষ্ণবসেনামধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া বলিল, “চল, টিলায় চড় |” নিকটে যাহারা ছিল, তাহারা বিস্মিত হইয়া বলিল, “কেন?”

যোদ্ধা এক মৃত্তিকাস্তূপের উপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “চল এই জ্যোৎস্নারাত্রে ঐ পর্বতশিখরে, নূতন বসন্তের নূতন ফুলের গন্ধ শুঁকিতে শুঁকিতে আজ আমাদের শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে হইবে।” সন্তানেরা দেখিল, সেনাপতি জীবানন্দ।

তখন “হরে মুরারে” উচ্চ শব্দ করিয়া যাবতীয় সন্তানসেনা বল্লমে ভর করিয়া উঁচু হইয়া উঠিলম; এবং সেই সেনা জীবানন্দের অনুকরণ পূর্বক বেগে টিলার উপর আরোহণ করিতে লাগিল। একজন সজ্জিত অশ্ব আনিয়া জীবানন্দকে দিল। দূর হইতে মহেন্দ্র দেখিয়া বিস্মিত হইল। ভাবিল, একি এ? না বলিতে ইহারা আসে কেন?

এই ভাবিয়া মহেন্দ্র ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া চাবুকের ঘায়ে ধোঁয়া করিয়া উড়াইয়া দিয়া পর্বত অবতরণ করিতে লাগিলেন। সন্তানবাহিনীর অগ্রবর্তী জীবানন্দের সাক্ষাৎ পাইয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ আবার কি আনন্দ?”

জীবানন্দ হাসিয়া বলিলেন, “আজ বড় আনন্দ। টিলার ওপিঠে এড‍ওয়ার্ড‍স সাহেব। যে আগে উপরে উঠবে, তারই জিত |”

তখন জীবানন্দ সন্তানসৈন্যের প্রতি ডাকিয়া বলিলেন, “চেন তোমরা! আমি জীবানন্দ গোস্বামী। সহস্র শত্রুর প্রাণবধ করিয়াছি |”

তুমুল নিনাদে কানন প্রান্তর সব ধ্বনিত করিয়া শব্দ হইল, “চিনি তোমরা! তুমি জীবানন্দ গোস্বামী |”

জী। বল “হরে মুরারে |”

কানন প্রান্তর সহস্র সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হইল, “হরে মুরারে!

জী। টিলার ওপিঠে শত্রু। আজ এই স্তূপশিখরে, এই নীলাম্বরী যামিনী সাক্ষাৎকার, সন্তানেরা রণ করিবে। দ্রুত আইস, যে আগে শিখরে উঠিবে, সেই জিতিবে। বল, “বন্দে মাতরম্ |”