সত্যানন্দ বলিলেন, “কে তুমি?”

উপর হইতে উত্তর হইল, “আমি নবীনানন্দ |”

তখন সত্যানন্দ বলিলেন, “তোমরা দশ সহস্র সন্তান, আজ তোমাদেরই জয় হইবে, তোপ কাড়িয়া লও”। তখন অগ্রবর্তী অশ্বারোহী জীবানন্দ বলিলেন, “আইস |”

সেই দশ সহস্র সন্তান – অশ্ব ও পদাতি, অতিবেগে জীবানন্দের অনুবর্তী হইল। পদাতির স্কন্ধে বন্দুক, কটীতে তরবারি, হস্তে বল্লম। কানন হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবামাত্র, সেই অজস্র গোলাবৃষ্টি পড়িয়া তাহাদিগকে ছিন্ন ভিন্ন করিতে লাগিল। বহুতর সন্তান বিনা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিয়া ভূমিশায়ী হইল। একজন জীবানন্দকে বলিল, “জীবানন্দ, অনর্থক প্রাণিহত্যায় কাজ কি?”

জীবানন্দ ফিরিয়া চাহিয়া দেখিলেন ভবানন্দ – জীবানন্দ উত্তর করিলেন, “কি করিতে বল |”

ভ। বনের ভিতর থাকিয়া বৃক্ষের আশ্রয় হইতে আপনাদিগের প্রাণরক্ষা করি – তোপের মুখে, পরিষ্কার মাঠে, বিনা তোপে এ সন্তানসৈন্য এক দণ্ড টিকিবে না ; কিন্তু ঝোপের ভিতর থাকিয়া অনেক্ষণ যুদ্ধ করা যাইতে পারিবে।

জী। তুমি সত্য কথা বলিয়াছ, কিন্তু প্রভু আজ্ঞা করিয়াছেন, তোপ কাড়িয়া লইতে হইবে, অতএব আমরা তোপ কাড়িয়া লইতে যাইব।

ভ। কার সাধ্য তোপ কাড়ে? কিন্তু যদি যেতেই হবে, তুমি নিরস্ত হও, আমি যাইতেছি।

জী। তা হবে না – ভবানন্দ! আজ আমার মরিবার দিন।

ভ। আজ আমার মরিবার দিন।

জী। আমার প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে।

ভ। তুমি নিষ্পাপশরীর – তোমার প্রায়শ্চিত্ত নাই। আমার চিত্ত কলুষিত – আমাকেই মরিতে হইবে – তুমি থাক, আমি যাই।

জী। ভবানন্দ! তোমার কি পাপ, তাহা আমি জানি না। কিন্তু তুমি থাকিলে সন্তানের কার্যোদ্ধার হইবে। আমি যাই।

ভবানন্দ নীরব হইয়া শেষে বলিলেন, “মরিবার প্রয়োজন হয় আজই মরিব, যে দিন মরিবার প্রয়োজন হইবে, সেই দিন মরিব, মৃত্যুর পক্ষে আবার কালাকাল কি?”

জী। তবে এস।

এই কথার পর ভবানন্দ সকলের অগ্রবর্তী হইলেন। তখন দলে দলে, ঝাঁকে ঝাঁকে গোলা পড়িয়া সন্তানসৈন্য খণ্ড বিখণ্ড করিতেছে, ছিঁড়িয়া চিরিতেছে, উল্টাইয়া ফেলিয়া দিতেছে, তাহার উপর শত্রুর বন্দুকওয়ালা সিপাহী সৈন্য অব্যর্থ লক্ষ্যে সারি সারি সন্তানদলকে ভূমে পাড়িয়া ফেলিতেছে। এমন সময়ে ভবানন্দ বলিলেন, “এই তরঙ্গে আজ সন্তানকে ঝাঁপ দিতে হইবে – কে পার ভাই? এই সময় গাও “বন্দে মাতরম্!” তখন উচ্চ নিনাদে মেঘমল্লার রাগে সেই সহস্রকণ্ঠ সন্তানসেনা তোপের তালে গায়িল, “বন্দে মাতরম্ |”