অষ্টম পরিচ্ছেদ

সে রাত্রি শান্তি মঠে থাকিবার অনুমতি পাইয়াছিলেন। অতএব ঘর খুঁজিতে লাগিলেন। অনেক ঘর খালি পড়িয়া আছে। গোবর্ধন নামে এক জন পরিচারক – সেও ক্ষুদ্রদরের সন্তান – প্রদীপ হাতে করিয়া ঘর দেখাইয়া বেড়াইতে লাগিল। কোনটাই শান্তির পছন্দ হইল না। হতাশ হইয়া গোবর্ধন ফিরিয়া সত্যানন্দের কাছে শান্তিকে লইয়া চলিল।

শান্তি বলিল, “ভাই সন্তান, এই দিকে যে কয়টা ঘর রহিল, এ ত দেখা হইল না?”

গোবর্ধন বলিল, “ও সব খুব ভাল ঘর বটে, কিন্তু ও সকলে লোক আছে”।

শা। কারা আছে?

গো। বড় বড় সেনাপতি আছে।

শা। বড় বড় সেনাপতি কে?

গো। ভবানন্দ, জীবানন্দ, ধীরানন্দ, জ্ঞানানন্দ। আনন্দমঠ আনন্দময়।

শা। ঘরগুলো দেখি চল না।

গোবর্ধন শান্তিকে প্রথমে ধীরানন্দের ঘরে লইয়া গেল। ধীরানন্দ মহাভারতের দ্রোণপর্ব পড়িতেছিলেন। অভিমন্যু কি প্রকারে সপ্ত রথীর সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছিল, তাহাতেই মন নিবিষ্ট – তিনি কথা কহিলেন না। শান্তি সেখান হইতে বিনা বাক্যব্যয়ে চলিয়া গেল। শান্তি পরে ভবানন্দের ঘরে প্রবেশ করিল। ভবানন্দ ঊর্ধ্ব দৃষ্টি হইয়া, একখানা মুখ ভাবিতে‎ছিলেন। কাহার মুখ, তাহা জানি না, কিন্তু মুখখানা বড় সুন্দর, কৃষ্ণ কুঞ্চিত সুগন্ধি অলকরাশি আকর্ণপ্রসারি ভ্রূযুগের উপর পড়িয়া আছে। মধ্যে অনিন্দ্য ত্রিকোণ ললাটদেশ মৃত্যুর করাল কাল ছায়ায় গাহমান হইয়াছে। যেন সেখানে মৃত্যু ও মৃত্যুঞ্জয় দ্বন্দ্ব করিতেছে। নয়ন মুদ্রিত, ভ্রূযুগ স্থির, ওষ্ঠ নীল, গণ্ড পাণ্ডুর, নাসা শীতল, বক্ষ উন্নত, বায়ু বসন বিক্ষিপ্ত করিতেছে। তার পর যেমন করিয়া শরন্মেঘ-বিলুপ্ত চন্দ্রমা ক্রমে ক্রমে মেঘদল উদ্ভাসিত করিয়া, আপনার সৌন্দর্য বিকশিত করে, যেমন করিয়া প্রভাতসূর্য তরঙ্গাকৃত মেঘমালাকে ক্রমে ক্রমে সুবর্ণীকৃত করিয়া আপনি প্রদীপ্ত হয়, দিঙ্মণ্ডল আলোকিত করে, স্থল জল কীটপতঙ্গ প্রফুল্ল করে, তেমনি সেই শবদেহে জীবনের শোভার সঞ্চার হইতেছিল। আহা কি শোভা! ভবানন্দ তাই ভাবিতেছিল, সেও কথা কহিল না। কল্যাণীর রূপে তাহার হৃদয় কাতর হইয়াছিল, শান্তির রূপের উপর সে দৃষ্টিপাত করিল না।

শান্তি তখন গৃহান্তরে গেল। জিজ্ঞাসা করিল, “এটা কার ঘর?”

গোবর্ধন বলিল, “জীবানন্দ ঠাকুরের |”

শা। সে আবার কে? কৈ কেউ ত এখানে নেই।

গো। কোথায় গিয়াছেন, এখনি আসিবেন।

শা। এই ঘরটি সকলের ভাল।

গো। তা এ ঘরটা ত হবে না।

শা। কেন?

গো। জীবানন্দ ঠাকুর এখানে থাকেন।

শা। তিনি না হয় আর একটা ঘর খুঁজে নিন।