তখন কল্যাণী অপ্সরোনিন্দিত কণ্ঠে মোহভরে ডাকিতে লাগিলেন,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

মহেন্দ্রকে বলিলেন, “বল

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

কানননির্গত মধুর স্বর আর কল্যাণীর মধুর স্বরে বিমুগ্ধ হইয়া কাতরচিত্তে ঈশ্বর মাত্র সহায় মনে করিয়া মহেন্দ্রও ডাকিলেন,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

তখন চারি দিক হইতে ধ্বনি হইতে লাগিল,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

তখন যেন গাছের পাখীরাও বলিতে লাগিল,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

নদীর কলকলেও যেন শব্দ হইতে লাগিল,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

তখন মহেন্দ্র শোকতাপ ভুলিয়া গেলেন – উন্মত্ত হইয়া কল্যাণীর সহিত একতানে ডাকিতে লাগিলেন,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

কানন হইতেও যেন তাঁহাদের সঙ্গে একতানে শব্দ হইতে লাগিল,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

কল্যাণীর কণ্ঠ ক্রমে ক্ষীণ হইয়া আসিতে লাগিল, তবু ডাকিতেছেন,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

তখন ক্রমে ক্রমে কণ্ঠ নিস্তব্ধ হইল, কল্যাণীর মুখে আর শব্দ নাই, চক্ষু: নিমীলিত হইল, অঙ্গ শীতল হইল, মহেন্দ্র বুঝিলেন যে, কল্যাণী “হরে মুরারে” ডাকিতে ডাকিতে বৈকুণ্ঠধামে গমন করিয়াছেন। তখন পাগলের ন্যায় উচ্চৈ:স্বরে কানন বিকম্পিত করিয়া, পশুপক্ষিদিগকে চমকিত করিয়া মহেন্দ্র ডাকিতে লাগিলেন,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

 

সেই সময়ে কে আসিয়া তাঁহাকে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া, তাঁহার সঙ্গে তেমনি উচ্চৈ:স্বরে ডাকিতে লাগিল,

“হরে মুরারে মধুকৈটভারে |”

তখন সেই অনন্তের মহিমায়, সেই অনন্ত অরণ্যমধ্যে, অনন্তপথগামিনীর শরীরসম্মুখে দুই জনে অনন্তের নাম গীত করিতে লাগিলেন। পশুপক্ষী নীরব, পৃথিবী অপূর্ব শোভাময়ী – এই চরমগীতির উপযুক্ত মন্দির। সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে কোলে লইয়া বসিলেন।