আনন্দমঠ
আনন্দারণ্য হইতে তাঁহারা বাহিরে আসিলে কিছু দূরে সবৃক্ষ প্রান্তর আরম্ভ হইল। প্রান্তর এক দিকে রহিল, বনের ধারে ধারে রাজপথ। এক স্থানে অরণ্যমধ্য দিয়া একটি ক্ষুদ্র নদী কলকল শব্দে বহিতেছে। জল অতি পরিষ্কার, নিবিড় মেঘের মত কালো। দুই পাশে শ্যামল শোভাময় নানাজাতীয় বৃক্ষ নদীকে ছায়া করিয়া আছে, নানাজাতীয় পক্ষী বৃক্ষে বসিয়া নানাবিধ রব করিতেছে। সেই রব – সেও মধুর – মধুর নদীর রবের সঙ্গে মিশিতেছে। তেমনি করিয়া বৃক্ষের ছায়া আর জলের বর্ণ মিশিয়াছে। কল্যাণীর মনও বুঝি সেই ছায়ার সঙ্গে মিশিল। কল্যাণী নদীতীরে এক বৃক্ষমূলে বসিলেন, স্বামীকে নিকটে বসিতে বলিলেন। স্বামী বসিলেন, কল্যাণী স্বামীর কোল হইতে কন্যাকে কোলে লইলেন। স্বামীর হাত হাতে লইয়া কিছুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাকে আজি বড় বিমর্ষ দেখিতেছি? বিপদ যাহা, তাহা হইতে উদ্ধার পাইয়াছি - এখন এত বিষাদ কেন?”
মহেন্দ্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “আমি আর আপনার নহি – আমি কি করিব বুঝিতে পারি না |”
ক। কেন?
ম। তোমাকে হারাইলে পর আমার যাহা যাহা ঘটিয়াছিল শুন। এই বলিয়া যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, মহেন্দ্র তাহা সবিস্তারে বলিলেন।
কল্যাণী বলিলেন, “আমারও অনেক কষ্ট, অনেক বিপদ গিয়াছে। তুমি শুনিয়া কি করিবে? অতিশয় বিপদেও আমার কেমন করে ঘুম আসিয়াছিল, বলিতে পারি না – কিন্তু আমি কাল শেষ রাত্রে ঘুমাইয়াছিলাম। ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম। দেখিলাম – কি পুণ্যবলে বলিতে পারি না – আমি এক অপূর্ব স্থানে গিয়াছি। সেখানে মাটি নাই। কেবল আলো, অতি শীতল মেঘভাঙ্গা আলোর মত বড় মধুর আলো। সেখানে মনুষ্য নাই, কেবল আলোময় মূর্তি, সেখানে শব্দ নাই, কেবল অতিদূরে যেন কি মধুর গীতবাদ্য হইতেছে, এমনি একটা শব্দ। সর্বদা যেন নূতন ফুটিয়াছে, এমনি লক্ষ লক্ষ মল্লিকা, মালতী, গন্ধরাজের গন্ধ। সেখানে যেন সকলের উপরে সকলের দর্শনীয় স্থানে কে বসিয়া আছেন, যেন নীল পর্বত অগ্নিপ্রভ হইয়া ভিতরে মন্দ মন্দ জ্বলিতেছে। অগ্নিময় বৃহৎ কিরীট তাঁহার মাথায়। তাঁর যেন চারি হাত। তাঁর দুই দিকে কি, আমি চিনিতে পারিলাম না – বোধ হয় স্ত্রীমূর্তি, কিন্তু এত রূপ, এত জ্যোতি:, এত সৌরভ যে, আমি সেদিকে চাহিলেই বিহ্বল হইতে লাগিলাম; চাহিতে পারিলাম না, দেখিতে পারিলাম না যে কে। যেন সেই চতুর্ভুজের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আর এক স্ত্রীমূর্তি। সেও জ্যোতির্ময়ী; কিন্তু চারিদিকে মেঘ, আভা ভাল বাহির হইতেছে না, অস্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, অতি শীর্ণা, কিন্তু অতি রূপবতী মর্মপীড়িতা কোন স্ত্রীমূর্তি কাঁদিতেছে। আমাকে যেন সুগন্ধ মন্দ পবন বহিয়া বহিয়া, ঢেউ দিতে দিতে, সেই চতুর্ভুজের সিংহাসনতলে আনিয়া ফেলিল। যেন সেই মেঘমণ্ডিতা শীর্ণা স্ত্রী আমাকে দেখাইয়া বলিল, ‘এই সে – ইহারই জন্য মহেন্দ্র আমার কোলে আসে না |’ তখন যেন এক অতি পরিষ্কার সুমধুর বাঁশীর শব্দের মত শব্দ হইল। সেই চতুর্ভুজ যেন আমাকে বলিলেন, ‘তুমি স্বামীকে ছাড়িয়া আমার কাছে এস। এই তোমাদের মা, তোমার স্বামী এঁর সেবা করিবে। তুমি স্বামীর কাছে থাকিলে এঁর সেবা হইবে না; তুমি চলিয়া আইস |’-আমি যেন কাঁদিয়া বলিলাম, ‘স্বামী ছাড়িয়া আসিব কি প্রকারে’। তখন আবার বাঁশীর শব্দে শব্দ হইল, ‘আমি স্বামী, আমি মাতা, আমি পিতা, আমি পুত্র, আমি কন্যা, আমার কাছে এস |’ আমি কি বললাম মনে নাই। আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল |” এই বলিয়া কল্যাণী নীরব হইয়া রহিলেন।
মহেন্দ্র বিস্মিত, স্তম্ভিত, ভীত হইয়া নীরবে রহিলেন। মাথার উপর দোয়েল ঝঙ্কার করিতে লাগিল। পাপিয়া স্বরে আকাশ প্লাবিত করিতে লাগিল। কোকিল দিঙ্মণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। “ভৃঙ্গরাজ” কলকণ্ঠে কানন কম্পিত করিতে লাগিল। পদতলে তটিনী মৃদু কল্লোল করিতেছিল। বায়ু বন্য পুষ্পের মৃদু গন্ধ আনিয়া দিতেছিল। কোথাও মধ্যে মধ্যে নদীজলে রৌদ্র ঝিকিমিকি করিতেছিল। কোথাও তালপত্র মৃদু পবনে মর্মর শব্দ করিতেছিল। দূরে নীল পর্বতশ্রেণী দেখা যাইতেছিল। দুই জনে অনেক্ষণ মুগ্ধ হইয়া নীরবে রহিলেন। অনেক্ষণ পরে কল্যাণী পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবিতেছ?”