আনন্দমঠ
মহেন্দ্র দেখিল, দস্যু গায়িতে গায়িতে কাঁদিতে লাগিল। মহেন্দ্র তখন সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কারা?” ভবানন্দ বলিল, “আমরা সন্তান |”
ম। সন্তান কি? কার সন্তান?
ভ। মায়ের সন্তান।
ম। ভাল – সন্তানে কি চুরি-ডাকাতি করিয়া মায়ের পূজা করে? সে কেমন মাতৃভক্তি?
ভ। আমরা চুরি-ডাকাতি করি না।
ম। এই ত গাড়ি লুঠিলে।
ভ। সে কি চুরি-ডাকাতি? কার টাকা লুঠিলাম?
ম। কেন? রাজার।
ভ। রাজার? এই যে টাকাগুলি সে লইবে, এ টাকায় তার কি অধিকার?
ম। রাজার রাজভাগ।
ভ। যে রাজা রাজ্য পালন করে না, সে আবার রাজা কি?
ম। তোমরা সিপাহীর তোপের মুখে কোন্ দিন উড়িয়া যাইবে দেখিতেছি।
ভ। অনেক শালা সিপাহী দেখিয়াছি – আজিও দেখিলাম।
ম। ভাল করে দেখনি, একদিন দেখিবে।
ভ। না হয় দেখলাম, একবার বই ত আর দুবার মরব না।
ম। তা ইচ্ছা করিয়া মরিয়া কাজ কি?
ভ। মহেন্দ্র সিংহ, তোমাকে মানুষের মত মানুষ বলিয়া আমার কিছু বোধ ছিল, কিন্তু এখন দেখিলাম, সবাই যা, তুমিও তা। কেবল দুধ ঘির যম। দেখ, সাপ মাটিতে বুক দিয়া হাঁটে, তাহা অপেক্ষা নীচ জীব আমি ত আর দেখিব না; সাপের ঘাড়ে পা দিলে সেও ফণা ধরিয়া উঠে। তোমার কি কিছুতেই ধৈর্য নষ্ট হয় না? দেখ, যত দেশ আছে, --- মগধ, মিথিলা, কাশী, কাঞ্চী, দিল্লী, কাশ্মীর, কোন্ দেশের এমন দুর্দশা, কোন্ দেশে মানুষ খেতে না পেয়ে ঘাস খায়? কাঁটা খায়? উইমাটি খায়? বনের লতা খায়? কোন্ দেশে মানুষ শিয়াল-কুক্কুর খায়, মড়া খায়? কোন্ দেশের মানুষের সিন্দুকে টাকা রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, সিংহাসনে শালগ্রাম রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঘরে ঝি-বউ রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঝি-বউয়ের পেটে ছেলে রেখে সোয়াস্তি নাই? পেট চিরে ছেলে বার করে। সকল দেশের রাজার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের সম্বন্ধ; আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্তও যায়। এ নেশাখোর দেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?
ম। তাড়াবে কেমন করে?
ভ। মেরে।
ম। তুমি একা তাড়াবে? এক চড়ে নাকি?
দস্যু গায়িল:-
“সপ্তকোটীকণ্ঠ-কলকল-নিনাদকরালে!
দ্বিসপ্তকোটীভুজৈর্ধৃতখরকরবালে
অবলা কেন মা এত বলে |”
মহে। কিন্তু দেখিতেছি তুমি একা।
ভ। কেন, এখনি ত দুশ লোক দেখিয়াছ।