দশম পরিচ্ছেদ

সেই জ্যোৎস্নাময়ী রজনীতে দুই জনে নীরবে প্রান্তর পার হইয়া চলিল। মহেন্দ্র নীরব, শোককাতর, গর্বিত, কিছু কৌতূহলী।

ভবানন্দ সহসা ভিন্নমূর্তি ধারণ করিলেন। সে স্থিরমূর্তি ধীরপ্রকৃতি সন্ন্যাসী আর নাই; সেই রণনিপুণ বীরমূর্তি – সৈন্যাধ্যক্ষের মুণ্ডঘাতীর মূর্তি আর নাই। এখনই যে গর্বিতভাবে সেই মহেন্দ্রকে তিরস্কার করিতেছিলেন, সে মূর্তি আর নাই। যেন জ্যোৎস্নাময়ী, শান্তিশালিনী, পৃথিবীর প্রান্তর-কানন-নদ-নদীময় শোভা দেখিয়া তাঁহার চিত্তের বিশেষ স্ফূর্তি হইল – সমুদ্র যেন চন্দ্রোদয়ে হাসিল। ভবানন্দ হাস্যমুখ, বাঙ্ময়, প্রিয়সম্ভাষী হইলেন। কথাবার্তার জন্য বড় ব্যগ্র। ভবানন্দ কথোপকথনের অনেক উদ্যম করিলেন, কিন্তু মহেন্দ্র কথা কহিল না। তখন ভবানন্দ নিরুপায় হইয়া আপন মনে গীত আরম্ভ করিলেন,-

 

“বন্দে মাতরম্।

সুজলাং সুফলাং

মলয়জশীতলাম্

শস্যশ্যামলাং

মাতরম্ |”1

 

মহেন্দ্র গীত শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইল, কিছু বুঝিতে পারিল না – সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা শস্যশ্যামলা মাতা কে,-জিজ্ঞাসা করিল, “মাতা কে?”

উত্তর না করিয়া ভবানন্দ গায়িতে লাগিলেন,-

 

“শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনীম্--

ফুল্ল-কুসুমিতদ্রুমদলশোভিনীম্

সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্

সুখদাং বরদাং মাতরম্ |”

 

মহেন্দ্র বলিল, “এ ত দেশ, এ ত মা নয়--”

ভবানন্দ বলিলেন, “আমরা অন্য মা মানি না–জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। আমরা বলি, জন্মভূমিই জননী, আমাদের মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, বন্ধু নাই,--স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ী নাই, আমাদের কাছে কেবল সেই সুজলা, সুফলা, মলয়জসমীরণশীতলা শস্যশ্যামলা,---”

তখন বুঝিয়া মহেন্দ্র বলিলেন, “তবে আবার গাও |”

ভবানন্দ আবার গায়িলেন,-


1- মল্লার–কাওয়ালী তাল যথা–বন্দে মাতরম্ ইত্যাদি।