রাজসিংহ
অতএব ঔরঙ্গজেব তাহার কথাবার্তায় সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইতেন না। তিনি মনে মনে এইরূপ বিচার করিলেন,-“মেবার আমি, সৈন্যের সাগরে ডুবাইয়া দিব, তাহাতে সন্দেহই করি না–রাজসিংহের রাজ্য থাকিবে না। কিন্তু তাহাতেই আমার মান বজায় হইবে না। তাহার রূপনগরী রাণীকে না কাড়িয়া আনিতে পারিলে আমার মান বজায় হইবে না। কিন্তু রাজ্য পাইলেই যে আমি রাজমহিষীকে পাইব, এমন ভরসা করা যায় না। কেন না, রাজপুতের মেয়ে, কথায় কথায় চিতায় উঠিয়া পুড়িয়া মরে, কথায় কথায় বিষ খায়। আমার হাতে পড়িবার আগে যে শয়তানী প্রাণত্যাগ করিবে। কিন্তু এই বাঁদীটাকে যদি হস্তগত করিতে পারি–বশীভূত করিতে পারি–তবে ইহা দ্বারা তাহাকে ভুলাইয়া আনিতে পারিব না? এ বাঁদীটা কি বশীভূত হইবে না? আমি দিল্লীর বাদশাহ, আমি একটা বাঁদীকে বশীভূত করিতে পারিব না? না পারি, তবে আমার বাদশাহী নামোনাসেফ্ |”
তার পর বাদশাহের ইঙ্গিতে জেব-উন্নিসা নির্মলকুমারীকে রত্নালঙ্কারে ভূষিত করিলেন। তাঁর বেশভূষা, এল্বাস পোষাক, বেগমদিগের সঙ্গে সমান হইল। নির্মল যাহা বলিতেন, তাহা হইত; যাহা চাহিতেন, তাহা পাইতেন। কেবল বাহির হইতে পারিতেন না।
এ সব কথা লইয়া যোধপুরীর সঙ্গে নির্মলের আন্দোলন হইত। একদা হাসিয়া নির্মল , যোধপুরীকে বলিল,-
সেখানে কি পিঁজিরা
সোনে কি চিড়িয়া
সোনে কি জিঞ্জির পয়ের মে,
সোনে কি চানা, সোনে কি দানা,
মট্টি কেঁও সেরেফ খয়ের মে।
সোনে কি জিঞ্জির পয়ের মে,
সোনে কি চানা, সোনে কি দানা,
মট্টি কেঁও সেরেফ খয়ের মে।
যোধপুরী জিজ্ঞাসা করিল, “তুই নিস কেন?”
নির্মল বলিল, “উদয়পুরে গিয়া দেখাইব যে, মোগল বাদশাহকে ঠকাইয়া আনাইয়াছি |”
জেব-উন্নিসা ঔরঙ্গজেবের দাহিন হাত। ঔরঙ্গজেবের আদেশ পাইয়া, জেব-উন্নিসা নির্মলকে লইয়া পড়িলেন। আসল কাজটা শাহজাদীর হাতে রহিল–বাদশাহ নিজে মধুর আলাপের ভারটুকু আপন হাতে রাখিলেন। নির্মলের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করিতেন, কিন্তু তাহাও একটু বাদশাহী রকমের মাজাঘষা থাকিত–নির্মল রাগ করিতে পারিত না, কেবল উত্তর করিত, তাও মেয়েলী রকম মাজাঘষা, তবে রূপনগরের পাহাড়ের কর্কশতাশূন্য নহে। এখনকার ইংরেজী রুচির সঙ্গে ঠিক মিলিবে না বলিয়া সেই বাদশাহী রুচির উদাহরণ দিতে পারিলাম না।
জেব-উন্নিসার কাছে নির্মলের যাহা বলিবার আপত্তি নাই, তাহা সে অকপটে বলিয়াছিল। অন্যান্য কথার মধ্যে রূপনগরের যুদ্ধটা কি প্রকারে হইয়াছিল, সে কথাও পাড়িয়াছিল। নির্মল যুদ্ধের প্রথম ভাগে কিছুই দেখে নাই, কিন্তু চঞ্চলকুমারীর কাছে সে সকল কথা শুনিয়াছিল। যেমন শুনিয়াছিল, জেব-উন্নিসাকে তেমনই শুনাইল। মবারক যে মোগল সৈন্যকে ডাকিয়া চঞ্চলকুমারীর কাছে পরাভব স্বীকার করিয়া, রণজয় ত্যাগ করিতে বলিয়াছিল, তাহা বলিল; চঞ্চলকুমারীর যে রাজপুতগণের রক্ষার্থ ইচ্ছাপূর্বক দিল্লীতে আসিতে চাহিয়াছিল, তাহাও বলিল। বিষ খাইবার ভরসার কথাও বলিল; মবারক যে চঞ্চলকুমারীকে লইয়া আসিল না, তাহাও বলিল।
শুনিয়া জেব-উন্নিসা মনে মনে বলিলেন, “মবারক সাহেব! এই অস্ত্রে তোমার কাঁধ হইতে মাথা নামাইব |” উপযুক্ত অবসর পাইলে, জেব-উন্নিসা ঔরঙ্গজেবকে যুদ্ধের সেই ইতিহাস শুনাইলেন।