গদ্য পদ্য বা কবিতাপুস্তক
বৃষ্টিবিন্দু। বাছা, আসল কথাটা ভুলে গেলে? পুকুর পুরায় কে? হে পঙ্কজে, বৃষ্টি নহিলে জগতে পাঁকও থাকিত না, জলও থাকিত না, তুমি ভাসিতেও পাইতে না, হাসিতেও পাইতে না। হে জলজে, তুমি আমাদের ঘরের মেয়ে, তাই আমরা তোমাকে বুকে করিয়া পালন করি,-নহিলে তোমায় এ রূপও থাকিত না, এ সুবাসও থাকিত না, এ গর্ব্বও থাকিত না। পাপীয়সি! জানিস্ না-তুই তোর পিতৃকুলবৈরী সেই অগ্নিপিণ্ডটার অনুরাগিণী!
যূঁই। ছি! প্রাণাধিক! ও মাগীটার সঙ্গে কি অত কথা কহিতে আছে। ওটা সকাল থেকে মুখ খুলিয়া সেই অগ্নিময় নায়কের মুখপানে চাহিয়া থাকে ; সেটা যে দিকে যায়, সেই দিকে মুখ ফিরাইয়া হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকে, এর মধ্যে কত বোলতা, ভোমরা, মৌমাছি আসে, তাতেও লজ্জা নাই। অমন বেহায়া জলেভাসা, ভোমরা মৌমাছি আশা, কাঁটার বাসার সঙ্গে কথা কহিতে আছে কি?
কৃষ্ণকলি। বলি, ও যূঁই, ভোমরা কথাটা ঘরে ঘরে নয় কি?
যূঁই। আপনাদের ঘরের কথা কও দিদি, আমি ত এই ফুটিলাম। ভোমরা মৌমাছির জ্বালা ত এখনও কিছু জানি না।
বৃষ্টিবিন্দু। তুমিই বা কেন বাজে লোকের সঙ্গে কথা কও! যারা আপনারা কলঙ্কিনী, তারা কি তোমার মত অমল ধবল শোভা, এমন সৌরভ দেখিয়া সহ্য করিতে পারে?
পদ্ম। ভাল রে ক্ষুদে! ভাল! খুব বক্তৃতা কর্চিস! ঐ দেখ, বাতাস আসচে!
যূঁই। সর্ব্বনাশ! কি বলে যে!
বৃষ্টিবিন্দু। তাই ত! আমার আর থাকা হইল না।
যূঁই। থাক না!
বৃষ্টিবিন্দু। থাকিতে পারিব না। বাতাস আমাকে ঝরাইয়া দিবে।-আমি উহার বলে পারি না।
যূঁই। আর একটু থাক না।
[বাতাসের প্রবেশ]
বাতাস। (বৃষ্টিবিন্দুর প্রতি) নাম্।
বৃষ্টিবিন্দু। কেন মহাশয়!
বাতাস। আমি এই অমল কমল সুশীতল সুবাসিত ফুল্লকলিকা লইয়া ক্রীড়া করিব! তুই বেটা অধঃপতিত, নীচগামী, নীচবংশ-তুই এই সুখের আসনে বসিয়া থাকিবি? নাম্!
বৃষ্টিবিন্দু। আমি আকাশ থেকে এয়েছি।
বাতাস। তুই বেটা পার্থিবযোনি-নীচগামী-খালে বিলে খানায় ডোবায় থাকিস-তুই এ আসনে? নাম্।
বৃষ্টিবিন্দু। যূথিকে! আমি তবে যাই।
যূঁই। থাক না।
বৃষ্টিবিন্দু। থাকিতে দেয় না যে।
যূঁই। থাক না-থাক না-থাক না।
বাতাস। তুই অত ঘাড় নাড়িস কেন?
যূঁই। তুই সর।
বাতাস। আমি তোকে ধরি, সুন্দরি! [যূথিকার সরিয়া সরিয়া পলায়নের চেষ্টা]
বৃষ্টিবিন্দু। এত গোলযোগে আর থাকিতে পারি না।
যুঁই। তবে আমার যা কিছু আছে, তোমাকে দিই, ধূইয়া লইয়া যাও।
বৃষ্টিবিন্দু। কি আছে?
যূঁই। একটু সঞ্চিত মধু-আর একটু পরিমল।
বাতাস। পরিমল আমি নিব-সেই লোভেই আমি এসেছি। দে-
[বায়ুকৃত পুষ্প প্রতি বল প্রয়োগ]
যূঁই। (বৃষ্টিবিন্দুর প্রতি) তুমি যাও-দেখিতেছ না ডাকাত!
বৃষ্টিবিন্দু। তোমাকে ছাড়িয়া যাই কি প্রকারে? যে তাড়া দিতেছ, থাকিতেও পারি না-যাই-যাই-
[বৃষ্টিবিন্দুর ভূপতন]
টগর ও কৃষ্ণকলি। এখন, কেমন স্বর্গবাসী! আকাশ থেকে নেমে এয়েচ না? এখন মাটিতে শোষ, নরদমায় পশ, খালে বিলে ভাস-
যূঁই। (বাতাসের প্রতি) ছাড়! ছাড়!
বাতাস। কেন ছাড়িব? দে পরিমল দে!
যূঁই। হায়! কোথা গেলে তুমি অমল, কোমল, স্বচ্ছ, সুন্দর, সূর্য্যপ্রতিভাত, রসময়, জলকণা! এ হৃদয় স্নেহে ভরিয়া আবার শূন্য করিলে কেন জলকণা! একবার রূপ দেখাইয়া, স্নিগ্ধ করিয়া, কোথায় মিশিলে, কোথায় শুষিলে প্রাণাধিক! হায়, আমি কেন তোমার সঙ্গে গেলেম না, কেন তোমার সঙ্গে মরিলাম না! কেন অনাথ, অস্নিগ্ধ পুষ্পদেহ লইয়া এ শূন্য প্রদেশে রহিলাম-
বাতাস। নে। কান্না রাখ্-পরিমল দে-
যূঁই। ছাড় ; নহিলে যে পথে আমার প্রিয় গিয়াছে, আমিও সেই পথে যাইব।
বাতাস। যাস্ যাবি, পরিমল দে।-হুঁ হুম্।
যূঁই। আমি মরিব-মরি-তবে চলিলাম।
বাতাস। হুঁ হুম্! [ইতি যূথিকার বৃন্তচ্যুতি ও ভূপতন]
বাতাস। হু! হায়! হায়!
যবনিকা পতন