অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, যদি লোক পড়েই না, টাকাই দেয় না, তবে এত ভস্মরাশির উপর আবার এ নূতন ছাইমুঠা ঢালিবার প্রয়োজন কি? সাময়িক সাহিত্য যদি আমরা ছাই ভস্মের মধ্যে গণনা করিতাম, তাহা হইলে অবশ্য আমরা এ কার্যে হাত দিতাম না। আমাদের বিবেচনায় সভ্যতা-বৃদ্ধির এবং জ্ঞানবিস্তারের সাময়িক সাহিত্য একটি প্রধান উপায়। যে সকল জ্ঞানগর্ভ এবং মনুষ্যের উন্নতিসাধক তত্ত্ব, দুষ্প্রাপ্য, দুর্বোধ্য এবং বহু পরিশ্রমে অধ্যয়নীয় গ্রন্থ সকলে, সাগর-গর্ভ-নিহিত রত্নের ন্যায় লুক্কায়িত থাকে, তাহা সাময়িক সাহিত্যের সাহায্যে সাধারণ সমীপে অনায়াসলভ্য হইয়া সুপরিচিত হয়। এমন কি, সাময়িক পত্র যদি যথাবিধি সম্পাদিত হয়, তাহা হইলে সাময়িক পত্রের সাধারণ পাঠকের অন্য কোন গ্রন্থ পড়িবার বিশেষ প্রয়োজন থাকে না। আর সাময়িক পত্রের সমকালিক লেখক ও ভাবুকদিগের মনে যে সকল নূতন তত্ত্ব আবির্ভূত হয়, তাহা সমাজে প্রচারিত করিবার সাময়িক পত্রই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। তাহা না থাকিলে লেখক ও ভাবুকদিগকে প্রত্যেককে এক একখানি নূতন গ্রন্থ প্রচার করিতে হয়। বহু সংখ্যক গ্রন্থ সাধারণ পাঠক কর্তৃক সংগৃহীত এবং অধীত হইবার সম্ভাবনা নাই। অতএব সাময়িক পত্রই প্রাচীন জ্ঞান এবং নূতন ভাব উভয় প্রচারপক্ষেই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। এই জন্যেই আমরা সর্ব-সাধারণ-সুলভ সাময়িক পত্রের প্রচারে ব্রতী হইয়াছি। আমাদের অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় যে, এই সময়ে, “নবজীবন” নামে অত্যুৎকৃষ্ট উচ্চদরের সাময়িক পত্রের প্রকাশ আরম্ভ হইয়াছে। আমরা সেই মহদ্দৃষ্টান্তের অনুগামী হইয়া এই ব্রত পালন করিতে যত্ন করিব। ‘সত্য, ধর্ম’ এবং ‘আনন্দের’ প্রচারের জন্যই আমরা এই সুলভ পত্র প্রচার করিলাম এবং সেই জন্যই ইহার নাম দিলাম “প্রচার।”

যখন সর্বসাধারণের জন্য আমরা পত্র প্রচার করিতেছি, তখন অবশ্য ইহা আমাদিগের উদ্দেশ্য যে, প্রচারের প্রবন্ধগুলি সর্বসাধারণের বোধগম্য হয়। আমাদিগের পূর্ববর্তী সম্পাদকেরা এ বিষয়ে কত দূর মনোযোগী হইয়াছিলেন, তাহা বলিতে পারি না—আমাদের এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ থাকিবে ইহা বলিতে পারি। কাজটি কঠিন, কৃতকার্য হইতে পারিব, এমন ভরসা অতি অল্প। তবে সাধারণপাঠ্য বলিয়া আমরা বালকপাঠ্য প্রবন্ধ ইহাতে সন্নিবেশিত করিব না। ভরসা করি, প্রচারে যাহা প্রকাশিত হইবে, তাহা অপণ্ডিত ও পণ্ডিত উভয়েরই আলোচনীয় হইবে। অনেকের বিশ্বাস আছে যে, যাহা অকৃতবিদ্য ব্যক্তি পড়িবে বা বুঝিবে বা শুনিবে, তাহা পণ্ডিতের পড়িবার বা বুঝিবার বা শুনিবার যোগ্য নয়। আমাদিগের এ বিষয়ে অনেক সংশয় আছে। আমরা দেখিয়াছি, মহাভারতের ব্যাখ্যা পণ্ডিতে ও মূর্খে তুল্য মনোভিনিবেশপূর্বক শুনিয়াছেন। ভিতরে সর্বত্রই মনুষ্য-প্রকৃতি এক। আমরা কিঞ্চিৎ জ্ঞানলাভ করিলে, অজ্ঞানীকে যতটা ঘৃণা করি, বোধ হয়, ততটার কোন উপযুক্ত কারণ নাই। অজ্ঞ এবং জ্ঞানী উভয়ে কান পাতিয়া শুনিতে পারেন আজকার দিনে এ বাঙ্গালা দেশে এমন অনেক বলিবার কথা আছে।

এ শিক্ষা শিখাইবে কে? এ পত্রের শিরোভাগে ত সম্পাদকের নাম নাই। থাকিবারও কোন প্রয়োজন দেখি না। সম্পাদক কে, পাঠকের জানিবারও কোন প্রয়োজন নাই; কেন না পাঠকেরা প্রবন্ধ পড়িবেন, সম্পাদককে পড়িবেন না। সম্পাদকের এমন কোন দাবি দাওয়া নাই যে, তিনি আত্মপরিচয় দিয়া পাঠকদিগের সম্মুখীন হইতে পারেন। তাঁহার কাজ, যাঁহারা বিদ্বান্, ভাবুক, রসজ্ঞ, লোকহিতৈষী এবং সুলেখক, তাঁহাদের লিখিত প্রবন্ধ সকল সংগ্রহ করিয়া পাঠকদিগকে উপহার প্রদান করেন। এ কাজ তিনি পারিবেন, এমন ভরসা করেন। আমরা মনুষ্যের নিকট সাহায্যের ভরসা পাইয়াছি। এক্ষণে যিনি মনুষ্যের জ্ঞানাতীত, যাঁহার নিকট মনুষ্যশ্রেষ্ঠও কীটাণুমাত্র, তাঁহার সাহায্যের প্রার্থনা করি। সকল সিদ্ধিই তাঁহার প্রসাদমাত্র এবং সকল অসিদ্ধি তাঁহার কৃত নিয়মলঙ্ঘনেরই ফল। —‘প্রচার’, শ্রাবণ ১২৯১, পৃ. ১-৬।