চন্দ্রশেখর
মহাকায় পুরুষ বলিলেন, “আছে ।” স্বপ্নাবস্থায় আত্মকৃত চীৎকারে শৈবলিনীর মোহনিদ্রা ভঙ্গ হইল। কিন্তু তখনও ভ্রান্তি যায় নাই—পৃষ্ঠে প্রস্তর ফুটিতেছে। শৈবলিনী ভ্রান্তিবেশে জাগ্রতেও ডাকিয়া বলিল, “আমার কি হবে! আমার উদ্ধারের কি উপায় নাই?”
গুহামধ্য হইতে গম্ভীর শব্দ হইল, “আছে ।”
এ কি এ? শৈবলিনী কি সত্যসত্যই নরকে? শৈবলিনী বিস্মিত, বিমুগ্ধ, ভীতচিত্তে জিজ্ঞাসা করিল, “কি উপায়?”
গুহামধ্য হইতে উত্তর হইল, “দ্বাদশবার্ষিক ব্রত অবলম্বন কর ।”
এ কি দৈববাণী? শৈবলিনী কাতর হইয়া বলিতে লাগিল, “কি সে ব্রত? কে আমায় শিখাইবে?”
উত্তর—আমি শিখাইব।
শৈ। তুমি কে?
উত্তর—ব্রত গ্রহণ কর।
শৈ। কি করিব?
উত্তর—তোমার ও চীনবাস ত্যাগ করিয়া, আমি যে বসন দিই, তাই পর। হাত বাড়াও।
শৈবলিনী হাত বাড়াইল। প্রসারিত হস্তের উপর একখণ্ড বস্ত্র স্থাপিত হইল। শৈবলিনী তাহা পরিধান করিয়া, পূর্ববস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আর কি করিব?”
উত্তর—তোমার শ্বশুরালয় কোথায়?
শৈ। বেদগ্রাম। সেখানে কি যাইতে হইবে?
উত্তর—হাঁ—গিয়া গ্রামপ্রান্তে পর্ণকুটীর নির্মাণ করিবে।
শৈ। আর?
উত্তর—ভূতলে শয়ন করিবে।
শৈ। আর?
উত্তর— ফলমূলপত্র ভিন্ন ভোজন করিবে না। একবার ভিন্ন খাইবে না।
শৈ। আর?
উত্তর— জটাধারণ করিবে।
শৈ। আর?
উত্তর—একবার মাত্র দিনান্তে গ্রামে ভিক্ষার্থ প্রবেশ করিবে। ভিক্ষাকালে গ্রামে গ্রামে আপনার পাপ কীর্তন করিবে।
শৈ। আমার পাপ যে বলিবার নয়! আর কি প্রায়শ্চিত্ত নাই?
উত্তর—আছে।
শৈ। কি?
উত্তর—মরণ।
শৈ। ব্রত গ্রহণ করিলাম—আপনি কে?
শৈবলিনী কোন উত্তর পাইল না। তখন শৈবলিনী সকাতরে পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি যেই হউন, জানিতে চাহি না। পর্বতের দেবতা মনে করিয়া আমি আপনাকে প্রণাম করিতেছি। আপনি আর একটি কথার উত্তর করুন, আমার স্বামী কোথায়?”
উত্তর—কেন?
শৈ। আর কি তাঁহার দর্শন পাইব না?
উত্তর—তোমার প্রায়শ্চিত্ত সমাপ্ত হইলে পাইবে।
শৈ। দ্বাদশ বৎসর পরে?
উত্তর—দ্বাদশ বৎসর পরে।
শৈ। এ প্রায়শ্চিত্ত গ্রহণ করিয়া কত দিন বাঁচিব? যদি দ্বাদশ বৎসর মধ্যে মরিয়া যাই?
উত্তর—তবে মৃত্যুকালে সাক্ষাৎ পাইবে।
শৈ। কোন উপায়েই কি তৎপূর্বে সাক্ষাৎ পাইব না? আপনি দেবতা, অবশ্য জানেন।
উত্তর—যদি এখন তাঁহাকে দেখিতে চাও, তবে সপ্তাহকাল দিবারাত্র এই গুহামধ্যে একাকিনী বাস কর। এই সপ্তাহ, দিনরাত্র কেবল স্বামীকে মনোমধ্যে চিন্তা কর—অন্য কোন চিন্তাকে মনোমধ্যে স্থান দিও না। এই সাত দিন, কেবল একবার সন্ধ্যাকালে নির্গত হইয়া ফলমূলাহরণ করিও; তাহাতে পরিতোষজনক ভোজন করিও না—যেন ক্ষুধানিবারণ না হয়। কোন মনুষ্যের নিকট যাইও না—বা কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হইলেও কথা কহিও না। যদি এই অন্ধকার গুহায় সপ্তাহ অবস্থিতি করিয়া, সরল চিত্তে অবিরত অনন্যমন হইয়া কেবল স্বামীর ধ্যান কর, তবে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইবে।