তার পর, বঙ্গদেশ যবনহস্তে পতিত হইল। পথিক যেমন বনে রত্ন কুড়াইয়া পায়, যবন সেইরূপ বঙ্গরাজ্য অনায়াসে কুড়াইয়া লইল। প্রথমে নাম মাত্র বঙ্গ দিল্লীর অধীন ছিল, পরে যবনশাসিত বঙ্গরাজ্য সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হইল। আবার বঙ্গদেশের কপালে ছিল যে জাতীয় জীবন কিঞ্চিৎ পুনরুদ্দীপ্ত হইবে। সেই পুনরুদ্দীপ্ত জীবন বলে, বঙ্গভূমি রঘুনাথ ও চৈতন্যদেব অবতীর্ণ হইলেন। বিদ্যাপতি তাঁহাদিগের পূর্বগামী,—পুনরুদ্দীপ্ত জাতীয় জীবনের প্রথম শিখা। তিনি জয়দেবপ্রণীত চিত্রখানি তুলিয়া লইলেন—তাহাতে নূতন রঙ্ ঢালিলেন। জয়দেব অপেক্ষা বিদ্যাপতির দৃষ্টি তেজস্বিনী—তিনি শ্রীকৃষ্ণকে কিশোরবয়স্ক বিলাসরত নায়কই দেখিলেন বটে, কিন্তু জয়দেব কেবল বাহ্য প্রকৃতি দেখিয়াছিলেন—বিদ্যাপতি অন্তঃপ্রকৃতি পর্যন্ত দেখিলেন। যাহা জয়দেবের চক্ষে কেবল ভোগ তৃষা বলিয়া প্রকটিত হইয়াছিল—বিদ্যাপতি তাহাতে অন্তঃপ্রকৃতির সম্বন্ধ দেখিলেন। জয়দেবের সময় সুখভোগের কাল, সমাজে দুঃখ ছিল না। বিদ্যাপতির সময় দুঃখের সময়। ধর্ম লুপ্ত, বিধর্মিগণ প্রভু, জাতীয় জীবন শিথিল, সবেমাত্র পুনরুদ্দীপ্ত হইতেছে—কবির চক্ষু ফুটিল। কবি, সেই দুঃখে, দুঃখ দেখাইয়া, দুঃখের গান গাইলেন। আমরা বঙ্গদর্শনের দ্বিতীয় খণ্ডে মানসবিকাশের সমালোচনা উপলক্ষে বিদ্যাপতি ও জয়দেবে প্রভেদ সবিস্তারে দেখাইয়াছি; সেই সকল কথার পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই। এস্থলে, কেবল ইহাই বক্তব্য যে, সাময়িক প্রভেদ, এই প্রভেদের একটি কারণ। বিদ্যাপতির সময়ে, বঙ্গদেশে চৈতন্যদেবকৃত ধর্মের নবাভ্যুদয়ের, এবং রঘুনাথকৃত দর্শনের নবাভ্যুদয়ের পূর্বসূচনা হইতেছিল; বিদ্যাপতির কাব্যে সেই নবাভ্যুদয়ের সূচনা লক্ষিত হয়। তখন বাহ্য ছাড়িয়া আভ্যন্তরিকে দৃষ্টি পড়িয়াছে। সেই আভ্যন্তরিক দৃষ্টির ফল ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্রের উন্নতি।

আমরা যে গ্রন্থকে উপলক্ষ করিয়া, এই কয়টি কথা বলিলাম, তৎসম্বন্ধে এক্ষণে কিছু বলা কর্তব্য। শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও শ্রীযুক্ত বাবু সারদাচরণ মিত্র “প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ” প্রকাশ করিতেছেন। যে দুই খণ্ড আমরা দেখিয়াছি, তাহাতে কেবল বিদ্যাপতির কয়েকটি গীত প্রকাশিত হইয়াছে। বিদ্যাপতি প্রভৃতি উৎকৃষ্ট প্রাচীন কবিদিগের উৎকৃষ্ট প্রাচীন কবিদিগের রচনা এক্ষণে অতি দুষ্প্রাপ্য। যাহাতে উহা পাওয়া যায়, তাহাতে এত ভেজাল মিশান যে, খাঁটি মাল বাছিয়া লইতে কাহারও প্রবৃত্তি হয় না। অক্ষয় বাবু ও সারদা বাবু উৎকৃষ্ট গীত সকল বাছিয়া শ্রেণীবদ্ধ করিয়া প্রকাশ করিতেছেন। বিদ্যাপতির রচনা পাঠ পক্ষে সাধারণ পাঠকের একটি প্রতিবন্ধক এই যে, তাঁহার ভাষা আধুনিক প্রচলিত বাঙ্গালা নহে—সাধারণ পাঠকের তাহা বুঝিতে বড় কষ্ট হয়। প্রকাশকেরা টীকায় দুরূহ শব্দ সকলের সদর্থ লিখিয়া সে প্রতিবন্ধকের অপনয়ন করিতেছেন। যে কার্যে ইঁহারা প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহা গুরুতর, সুকঠিন, এবং নিতান্ত প্রয়োজনীয়। ইঁহারা সে কার্যের উপযুক্ত ব্যক্তি। উভয়েই কৃতবিদ্য এবং অক্ষয় বাবু সাহিত্যসমাজে সুপরিচিত। তিনি কাব্যের সুপরীক্ষক, তাঁহার রুচি সুমার্জিত, এবং তিনি বিদ্যাপতির কাব্যের মর্মজ্ঞ। দুরূহ শব্দ সকলের ইঁহারা যে প্রকার সদর্থ করিয়াছেন, তাহাতে আমরা বিশেষ সাধুবাদ করিতে পারি। ভরসা করি, পাঠকসমাজ ইঁহাদিগের উপযুক্ত সহায়তা করিবেন।

—‘বঙ্গদর্শন’, চৈত্র ১২৮১, পৃ. ৫৪৭-৫৪।