পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
অতএব, কাব্যবৈচিত্র্যের তিনটি কারণ—জাতীয়তা, সাময়িকতা, এবং স্বাতন্ত্র্য। যদি চারি জন কবি কর্তৃক গীত কৃষ্ণচরিত্রে প্রভেদ পাওয়া যায়, তবে সে প্রভেদের কারণ তিন প্রকারই থাকিবার সম্ভাবনা। বঙ্গবাসী জয়দেবের সঙ্গে মহাভারতকার বা শ্রীমদ্ভাগবতকারের জাতীয়তাজনিত পার্থক্য থাকিবারই সম্ভাবনা; তুলসীদাসে এবং কৃত্তিবাসে আছে। আমরা জাতীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্য পরিত্যাগ করিয়া, সাময়িকতার সঙ্গে এই চারিটি কৃষ্ণচরিত্রের কোন সম্বন্ধ আছে কি না ইহারই অনুসন্ধান করিব।
মহাভারত কোন্ সময়ে প্রণীত হইয়াছিল, তাহা এ পর্যন্ত নিরূপিত হয় নাই। নিরূপিত হওয়াও অতি কঠিন। মূল গ্রন্থ একজন প্রণীত বলিয়াই বোধ হয়, কিন্তু এক্ষণে যাহা মহাভারত বলিয়া প্রচলিত তাহার সকল অংশ কখন একজনের লিখিত নহে। যেমন একজন একটি অট্টালিকা নির্মাণ করিয়া গেলে, তাঁহার পরপুরুষেরা তাহাতে কেহ একটি নূতন কুঠারি, কেহ বা একটি নূতন বারেণ্ডা, কেহ বা একটি নূতন প্রাচীন নির্মাণ করিয়া, তাহার বৃদ্ধি করিয়া থাকেন, মহাভারতেও তাহাই ঘটিয়াছে। মূলগ্রন্থের ভিতর পরবর্তী লেখকেরা কোথাও কতকগুলি কবিতা, কোথাও একটি উপন্যাস, কোথাও একটি পর্বাধ্যায় সন্নিবেশিত করিয়া বহু সরিতের জলে পুষ্ট সমুদ্রবৎ বিপুল কলেবর করিয়া তুলিয়াছেন। কোন্ ভাগ আদি গ্রন্থের অংশ, কোন্ ভাগ আধুনিক সংযোগ, তাহা সর্বত্র নিরূপণ করা অসাধ্য। অতএব আদি গ্রন্থের বয়ঃক্রম নিরূপণ অসাধ্য। তবে উহা যে শ্রীমদ্ভাগবতের পূর্বগামী ইহা বোধ হয় সুশিক্ষিত কেহই অস্বীকার করিবেন না। যদি অন্য প্রমাণ নাও থাকে, তবে কেবল রচনাপ্রণালী দেখিলে বুঝিতে পারা যায়। ভাগবতের সংস্কৃত অপেক্ষাকৃত আধুনিক ; ভাগবতে কাব্যের গতি অপেক্ষাকৃত আধুনিক পথে।
অতএব প্রথম মহাভারত। মহাভারত খ্রীষ্টাব্দের অনেক পূর্বে প্রণীত হইয়াছিল, ইহাও অনুভবে বুঝা যায়। মহাভারতে পড়িয়া বোধ হয়, ভারতবর্ষীয়দিগের দ্বিতীয়াবস্থা, অথবা তৃতীয়াবস্থা ইহাতে পরিচিত হইয়াছে। তখন দ্বাপর, সত্য যুগ আর নাই। যখন সরস্বতী ও দৃষদ্বতী তীরে, নবাগত আর্য বংশ, সরল গ্রাম্য ধর্ম রক্ষা করিয়া, দস্যুভয়ে আকাশ, ভাস্কর, মরুতাদি ভৌতিক শক্তিকে আত্মরক্ষার্থ আহ্বান করিয়া, অপেয় সোমরস পানকে জীবের সার সুখজ্ঞান করিয়া আর্য জীবন নির্বাহ করিতেন, সে সত্য যুগ আর নাই। দ্বিতীয়াবস্থাও নাই। যখন আর্যগণ সংখ্যায় পরিবর্ধিত হইয়া, বহু যুদ্ধে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করিয়া দস্যুজয়ে প্রবৃত্ত, সে ত্রেতা আর নাই। যখন আর্যগণ, বাহুবলে বহু দেশ অধিকৃত করিয়া শিল্পাদির উন্নতি করিয়া, প্রথম সভ্যতার সোপানে উঠিয়া, কাশী, অযোধ্যা, মিথিলাদি নগর সংস্থাপিত করিতেছেন, সে ত্রেতা আর নাই। যখন আর্যহৃদয়ক্ষেত্রে নূতন জ্ঞানের অঙ্কুর দেখা দিতেছে, সে ত্রেতা আর নাই। এক্ষণে দস্যু জাতি বিজিত, পদানত, দেশপ্রান্তবাসী শূদ্র, ভারতবর্ষ আর্যগণের করস্থ, আয়ত্ত, ভোগ্য, এবং মহাসমৃদ্ধিশালী। তখন আর্যগণ বাহ্য শত্রুর ভয় হইতে নিশ্চিন্ত, আভ্যন্তরিক সমৃদ্ধি সম্পাদনে সচেষ্ট, হস্তগতা অনন্তরত্নপ্রসবিনী ভারতভূমি অংশীকরণে ব্যস্ত। যাহা সকলে জয় করিয়াছে তাহা কে ভোগ করিবে? এই প্রশ্নের ফল আভ্যন্তরিক বিবাদ। তখন আর্য পৌরুষ চরমে দাঁড়াইয়াছে। যে হলাহল বৃক্ষের ফলে, দুই সহস্র বৎসর পরে জয়চন্দ্র এবং পৃথ্বীরাজ পরস্পর বিবাদ করিয়া উভয়ে সাহাবুদ্দিনের করতলস্থ হইলেন, এই দ্বাপরে তাহার বীজ বপন হইয়াছে। এই দ্বাপরের কার্য মহাভারত। (১) *
* পাঠক বুঝিতে পারিবেন যে কতিপয় শতাব্দীকে এখানে “যুগ” বলা হইতেছে।