পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
এমন নহে যে, সর্ জর্জ কাম্বেলের সময় কলে শাসন একেবারে ছিল না। শাসনের কল চিরকাল বজায় আছে; যিনি ইচ্ছা তিনি শাসনকর্তা হউন, সে কল মধ্যে মধ্যে বাতাসে নড়িবে; সকল শাসনকর্তাকেই শাসনের কল চালাইয়া কতকগুলি কার্য সম্পন্ন করিতে হইবে। তবে সর্ জর্জ কাম্বেল কলে সিদ্ধ তত্ত্বগুলি অবশ্যগ্রাহ্য মনে করিতেন না; ইচ্ছানুসারে তাহা ত্যাগ করিতেন; ইচ্ছানুসারে তত্তৎস্থানে নূতন সিদ্ধান্ত আদিষ্ট করিতেন। সর্ জর্জ কাম্বেল কল নিজে চালাইতেন, স্বয়ং কলের অংশ ছিলেন না।
সর্ উইলিয়ম গ্রে সকলের মন রাখিয়া কাজ করিতেন; গালিগালাজকে বড় ভয় করিতেন। সম্বাদপত্রের ভয়ে তটস্থ ছিলেন; ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান আসোসিয়েশনকে মুরুব্বি বলিয়া মানিতেন। সুখ্যাতির আশায় এবং গালির ভয়ে, তিনি সম্বাদপত্রের আজ্ঞাকারী ছিলেন। ব্রি. ই. আসোসিয়েশনের প্রধান মেম্বরদিগের কেনা বেচার মধ্যে ছিলেন। সর্ জর্জ কাম্বেল, কাহারও নিকট সুখ্যাতি খুঁজিতেন না; কাহারও অনুরোধ রাখিতেন না। সম্বাদপত্র সকলকে ঘৃণা করিতেন, ব্রিটিশ ইঃ আসোসিয়েশনকে ব্যঙ্গ করিতেন। অতএব একজন যে লোকের প্রিয়, আর একজন অপ্রিয় হইবেন ইহা সহজেই অনুমেয়।
সর্ উইলিয়ম গ্রে কিয়দংশ প্রিয়বাদী ছিলেন, সর্ জর্জ কাম্বেল বড় অপ্রিয়বাদী ছিলেন। সকলকে কটু বলায় সর্ জর্জ কাম্বেলের বিশেষ আমোদ ছিল। তাঁহার গুরুতর অহঙ্কারই এই অপ্রিয়বাদিত্বের একটি প্রধান কারণ। তিনি জানিতেন যে, পৃথিবীতে বুদ্ধিমান পণ্ডিত এবং বিজ্ঞ, একা সর্ জর্জ কাম্বেল; আর সকল মনুষ্যই মূর্খ, নির্বোধ, অসার, ভণ্ড এবং স্বার্থপর। তিরস্কারই তাহাদের প্রতি উপযুক্ত ব্যবহার। এইরূপ তমোভিভূত হইয়া সর্ জর্জ কাম্বেল কাহারও পরামর্শ গ্রাহ্য করিতেন না। নিজেও দেশের অবস্থা কিছুই জানিতেন না। অথচ সকল বিষয়েই আত্মবুদ্ধিমত মীমাংসা করিয়া হস্তক্ষেপ করিতেন। তাহাতে অনেক অনিষ্ট ঘটাইয়াছেন।
সর্ জর্জ কাম্বেল এদেশীয়গণকে বিশেষ ঘৃণা করিতেন। তিনি বিবেচনা করিতেন, ইহারা অকর্মণ্য—কোন গুরুতর ভাবের অযোগ্য। এই ঘৃণা তাঁহার শাসনকার্যের আর একটি ঘোরতর বিঘ্ন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। যাহার প্রতি ঘৃণা আছে তাহার সুখ দুঃখের ভাগী হওয়া যায় না, প্রজার সুখ দুঃখের ভাগী না হইলে, কখন প্রজার সুখ বৃদ্ধি, দুঃখ নিবারণ করা যায় না।
সর্ উইলিয়ম গ্রে ও জর্জ কাম্বেল উভয়েই স্বেচ্ছাচারী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। যিনি যাহা ধরিতেন, তিনি তাহা আর ছাড়িতে চাহিতেন না। দুই জনের “রোখ” বড় ভয়ানক ছিল—দণ্ড প্রণয়নের সাধ দুই জনেরই বড় গুরুতর ছিল। দুই জনেরই একটি নিতান্ত নিন্দনীয় দোষ ছিল যে, বিনাপরাধেও দণ্ডবিধান করিতেন। বিশেষ সর্ জর্জ কাম্বেলের ন্যায়নিষ্ঠতা কিছুই ছিল না।
স্থূল কথা এই যে, সর্ জর্জ কাম্বেল অত্যন্ত গর্বিত, আত্মাভিমানী, কৃষ্ণচর্মে ঘৃণাবিশিষ্ট, পরোপদেশে বিরক্ত, স্বেচ্ছাচারী, অপ্রিয়বাদী, অপ্রিয়কারী, অন্যায়পর, শাসনকর্তা ছিলেন। সর্ উইলিয়ম গ্রের এত দোষ ছিল না; তিনি কেবল স্থূলবুদ্ধি ছিলেন; কোনরূপে লোকের মন রাখিয়া, কলে শাসন করিয়া, নিন্দার হাত হইতে মুক্তিলাভ তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল।
গুণ পক্ষে, সর্ জর্জ কাম্বেল সাহেবের নিতান্ত অভাব ছিল না। তিনি বুদ্ধিমান্, সুপণ্ডিত, পরিশ্রমী, এবং অধ্যবসায়সম্পন্ন। দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে দেখা গিয়াছে, তিনি ক্ষিপ্রকারী এবং দূরদর্শী। তিনি সাম্যবাদী। প্রজার কোন মঙ্গল সিদ্ধ করিয়া থাকুন, বা না থাকুন, তিনি প্রজার হিতৈষী। সর্ উইলিয়ম গ্রের গুণের মধ্যে কেবল ইহাই আমাদের স্মরণ হইতেছে যে, তিনি অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ ছিলেন। সর্ জর্জ কাম্বেলের মত বহু গুণে গুণবান্ ও বহু দোষে দোষী শাসনকর্তা কেহই এদেশে আসেন নাই; সর্ উইলিয়ম গ্রের মত দোষশূন্য ও গুণশূন্য কেহ আসেন নাই। গুণবান্ ও দোষযুক্তের শত্রু অনেক, নির্দোষ ও নির্গুণের শত্রু থাকে না। সর্ জর্জ কাম্বেলের নিন্দা এবং সর্ উইলিয়ম গ্রের সুখ্যাতির কারণই এই।