পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
সে রীতি দুই প্রকার। একটি রীতি, একটি সামান্য উদাহরণের দ্বারা বুঝাইব। মনে কর, বাঁধের কথা উপস্থিত। কমিশ্যনরের রিপোর্টে হউক, বোর্ডের রিপোর্টে হউক, ইঞ্জিনিয়রদিগের রিপোর্টে হউক, সংবাদপত্রে হউক, লেঃ গবর্ণর জানিলেন যে নদীতীরস্থ প্রাচীন বাঁধ সকল রক্ষিত হইতেছে না—তাহার উপায় করা কর্তব্য। তখন লেঃ গবর্ণরের হুকুম হইল যে, রিপোর্ট তলব কর। এই হুকুমে যদি কোন বিশেষ গুণশালিত্ব বা যোগ্যতা থাকে, তবে সে গুণশালিত্ব বা যোগ্যতা লেঃ গবর্ণরের। সেক্রেটরি সাহেব হুকুম পাইয়া, বোর্ডে চিঠি লিখিলেন—তাঁহার চিঠিতে কথাটা একটু বিস্তৃতি পাইল—তিনি বলিলেন ইহার বিশেষ অবস্থা জানিবে—অধীনস্থ কর্মচারীদিগের অভিপ্রায় কি তাহা লিখিবে, ইহার কিরূপ উপায় হইতে পারে তাহা লিখিবে। বোর্ড, ঐ পত্রখানির একাদশ খণ্ড অতি পরিষ্কার অনুলিপি প্রস্তুত করিয়া, একাদশ কমিশ্যনরের নিকট পাঠাইলেন। একাদশ কমিশ্যনর, অনুলিপি প্রাপ্ত হইয়া তাহার কোণে পেন্সিলে প্রাপ্তির তারিখ লিখিয়া বাক্সে ফেলিলেন, তাঁহার গুরুতর কর্তব্য কার্য সমাপ্ত হইল। বাক্স প্রাচীন প্রথানুসারে যথাসময়ে চাপরাশির স্কন্ধে আরোহণ করিয়া, কেরাণীর নিকট পৌঁছিল। কেরাণী তাহার আর এক খণ্ড পরিষ্কার অনুলিপি প্রস্তুত করিয়া সাত দিনের মিয়াদ লিখিয়া দিয়া, কালেক্টরদিগের নিকট পাঠাইলেন। যে পথে মহাজন যায় সেই পথ,—দোর্দণ্ড প্রচণ্ড প্রতাপান্বিত শ্রীল শ্রীযুক্ত কালেক্টর বাহাদুর, চুরুট খাইতে খাইতে চিঠির কোণে লিখিলেন, “সাব্ডিবিজন ও ডেপুটিগণ বরাবর।” চিঠি এইরূপে বড় ডাকঘর হইতে মেজো ডাকঘরে, মেজো ডাকঘর হইতে ছোট ডাকঘরে, এবং তথা হইতে শেষে আটচালা নিবাসী বোতামশূন্য চাপকানধারী কালকোল নাদুস নুদুস ডিপুটি বাহাদুরের ছিন্ন পাদুকামণ্ডিত শ্রীপাদপদ্মযুগলে মধুলুব্ধ ভ্রমরের ন্যায় আসিয়া পড়িল। ডিপুটি বাহাদুরেরা প্রায় উদরস্থ মহাত্মাদিগের অনুকরণ করিয়া, ইংরেজি চিঠির বাঙ্গালা পরওয়ানা করিয়া সব-ইনস্পেক্টরগণের নিকট ফেলফোর রিপোর্ট তলব করিলেন—সব-ইনস্পেক্টর পরওয়ানা কনষ্টেবলের হাওয়ালা করিল—কনষ্টেবল যে গ্রামে বাঁধ সেইখানে, কাল কোর্তা কাল দাড়ি এবং মোটা রুল লইয়া, দর্শন দিয়া এক অন্নাভাবে শীর্ণ ক্লিষ্ট চৌকিদারকে ধরিল। ধরিয়াই জিজ্ঞাসা করিল যে, “তোদের গাঁয়ের বাঁধ থাকে না কেন রে?” চৌকিদার ভীত হইয়া বলিল, “আজ্ঞা, জমীদারে মেরামত করে না, আমি গরিব মানুষ কি করিব?” কনষ্টেবল তখন জমীদারী কাছারিতে পদরেণু অর্পণ করিয়া গোমস্তাকে কিছু তম্বী করিলেন। গোমস্তা জমীদারী খাতায় পাঁচ টাকা খরচ লিখিয়া কনষ্টেবল বাবুকে দেড় টাকা পারিতোষিক দিয়া বিদায় করিলেন। কনষ্টেবল আসিয়া সব-ইনস্পেক্টর সমক্ষে রিপোর্ট করিলেন “বাঁধ সব বেমেরামত-জমীদার মেরামত করে না—জমীদার মেরামত করিলেই মেরামত হইতে পারে।” ডিপুটি বাহাদুর লিখিলেন “বাঁধ সব বেমেরামত-জমীদারেরা মেরামত করে না—তাহারা মেরামত করিলেই হয়।” কালেক্টর বাহাদুর সেই সকল কথা লিখিলেন, অধিকন্তু “এক্ষণে জমীদারদিগকে বাঁধ মেরামত করিলে বাধ্য করা উচিত।” কমিশ্যনর, সেই সকল কথা লিখিয়া বোর্ডে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এক্ষণে কি প্রকারে জমীদার বাঁধ মেরামত করিতে বাধ্য করিতে বাধ্য হইতে পারে?” বোর্ড তত্তদুক্তি পুনরুক্ত করিয়া, একটা যাহা হয় উপায় নির্দিষ্ট করিলেন। সেক্রেটরি সাহেব সেই সকল কথা সাজাইয়া লিখিয়া এক রিজলিউশনের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করিয়া পাঠাইলেন, লেঃ গবর্ণর সাহেব সম্মত হইয়া তাহাতে দস্তখত করিয়া দিলেন। আজ্ঞা দেশে প্রচারিত হইল; লেঃ গবর্ণর বাহাদুরের যশ দেশে বিদেশে ঘোষিল। যাহারা মিত্রপক্ষ তাহারা গবর্ণর বাহাদুরের প্রশংসা করিতে লাগিল—শত্রুপক্ষ নানা জাতীয় ইংরেজি বাঙ্গালায় তাঁহাকে গালি পাড়িতে লাগিল। নষ্টের গোড়া চৌকিদার নির্বিঘ্নে স্বদেশে কোদালি পাড়িতে লাগিল।