পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
এবং আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি যে, যত দিন ইংরেজের সমতুল্য না হই, তত দিন যেন আমাদিগের মধ্যে এই জাতিবৈরিতার প্রভাব এমনই প্রবল থাকে। যত দিন জাতিবৈর আছে, তত দিন প্রতিযোগিতা আছে। বৈরভাবের কারণই আমরা ইংরেজদিগের কতক কতক সমতুল্য হইতে যত্ন করিতেছি। ইংরেজদের নিকট অপমানগ্রস্ত, উপহসিত হইলে, যত দূর আমরা তাহাদিগের সমকক্ষ হইবার জন্য যত্ন করিব, তাহাদিগের কাছে বাপু বাছা ইত্যাদি আদর পাইলে ততদূর করিব না—কেন না সে গায়ের জ্বালা থাকিবে না। বিপক্ষের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা ঘটে—স্বপক্ষের সঙ্গে নহে। উন্নত শত্রুর উন্নতির উদ্দীপক—উন্নত বন্ধু আলস্যের আশ্রয়। আমাদিগের সৌভাগ্যক্রমেই ইংরেজের সঙ্গে আমাদিগের জাতিবৈর ঘটিয়াছে।
যদি শুভানুধ্যায়ীদিগের যত্ন সফল হইয়া, সম্প্রতি জাতিবৈরিতার উপশম ঘটে, তাহা হইলে আমরা যে মানসিক সম্বন্ধের কথা উপরে বলিয়াছি, তাহা অবশ্য ঘটিবে; জাতিবৈর উচ্ছিন্ন হইলেই নিকৃষ্ট জাতি উৎকৃষ্টের নিকট বিনীত, আজ্ঞাকারী এবং ভক্তিমান হইবে,—কেন না সে অবস্থা না ঘটিলে জাতিবৈর যাইবে না। এইরূপ মানসিক অবস্থা, উন্নতির পথরোধক। যে বিনীত, সে আত্মক্ষমতায় বিশ্বাসশূন্য,—যে পরের আজ্ঞানুকারী, সে আত্মানুবর্তিতাশূন্য,—এবং যে প্রভুর প্রতি ভক্তিমান্ সে প্রভুর প্রতি সকল ভার অর্পণ করিয়া আত্মকার্যে বিমুখ হয়। যখন বাঙ্গালী ইংরেজের তুল্য না হইয়াও ইংরেজের প্রতি জাতিবৈরশূন্য হইবে, তখন বাঙ্গালী আত্মোন্নতির সম্ভাবনায় বিশ্বাস করিবে না, তাহার চেষ্টাও করিবে না, আত্মচিত্তবৃত্তিকে স্ফূর্তি দিবে না, আত্মরক্ষায় যত্ন করিবে না। তখন ভাবী উন্নতির মূল এককালীন উৎপাটিত হইবে। সে দূরবস্থা কখন না ঘটুক! জাতিবৈর এখনও বহুকাল বঙ্গদেশে বিরাজ করুক।
অতএব জাতিবৈর স্বভাবসঙ্গত, এবং ইহার দূরীকরণ স্পৃহণীয় নহে। কিন্তু জাতিবৈর স্পৃহণীয় বলিয়া, পরস্পরের প্রতি দ্বেষভাব স্পৃহণীয় নহে। দ্বেষ, মনের প্রতি কুৎসিত অবস্থা; যাহার মনে স্থান পায় তাহার চরিত্র কলুষিত করে। বাঙ্গালী ইংরেজের প্রতি বিরক্ত থাকুন, কিন্তু ইংরেজের অনিষ্ট কামনা না করেন; ইংরেজ বাঙ্গালীর প্রতি বিরক্ত থাকুন, কিন্তু বাঙ্গালীর অনিষ্ট কামনা না করেন। জাতিবৈরের ফলে প্রতিযোগিতা ভিন্ন বিদ্বেষ ও অনিষ্ট কামনা না ঘটে। অনেক স্থানে তাহা ঘটিতেছে। —‘সাধারণী’, ১১ কার্তিক ১২৮০।