পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা
দুর্গা
শ্রীকৃষ্ণ এবং দুর্গা এই বঙ্গদেশের প্রধান আরাধ্য দেবতা। ইঁহাদিগের পূজা না করে এমত হিন্দু প্রায় বঙ্গদেশে নাই। কেবল পূজা নহে, কৃষ্ণভক্তি ও দুর্গাভক্তি এ দেশের লোকের সর্বকর্মব্যাপী হইয়াছে। প্রভাতে উঠিয়া শিশুরাও “দুর্গা দুর্গা” বলিয়া গাত্রোত্থান করে। যে কিছু লেখা পড়া আরম্ভ করিতে হইলে, আগে দুর্গা নাম লিখিতে হয়। “দুর্গে” “দুর্গে” “দুর্গতিনাশিনি” ইত্যাদি শব্দ অনেকের প্রতিনিঃশ্বাসেই নির্গত হয়। আমাদের প্রধান পর্বাহ দুর্গোৎসব। সেই উৎসব অনেকের জীবনমধ্যে প্রধান কর্ম বা প্রধান আনন্দ। সম্বৎসর তাহারই উদ্যোগে যায়। পথে পথে কালীর মঠ। অমাবস্যায় অমাবস্যায় কালীপূজা। কোন গ্রামে পীড়া আরম্ভ হইলে রক্ষাকালীপূজা। কাহারও কিছু অশুভ সম্ভাবনা হইলেই চণ্ডীপাঠ —অর্থাৎ কালীর মহিমা কীর্তন। ইঁহার প্রীত্যর্থে পূর্ববঙ্গে অনেক প্রাচীন বিজ্ঞ ব্যক্তিও মদ্যপান ও অন্যান্য কুৎসিত কর্মে রত। ফলে এই দেবী বঙ্গদেশ শাসন করিতেছেন। ডাকাইতেরা ইঁহার পূজা না দিয়া ডাকাইতি করে না।
এই দেবী কোথা হইতে আসিলেন? ইনি কে? আমাদিগের হিন্দু ধর্মকে সনাতন ধর্ম বলিবার কারণ এই যে, এই ধর্ম বেদমূলক। যাহা বেদে নাই, তাহা হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত কি না সন্দেহ। যদি হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে কোন গুরুতর কথা বেদে না থাকে, তবে হয় বেদ অসম্পূর্ণ, না হয় সেই কথা হিন্দুধর্মান্তর্গত নহে। বেদ অসম্পূর্ণ ইহা আমরা বলিতে পারি না, কেন না তাহা হইলে হিন্দু ধর্মের মূলোচ্ছেদ করিতে হয়। তবে দ্বিতীয় পক্ষই এমন স্থলে অবলম্বনীয় কি না, তাহা হিন্দুদিগের বিচার্য।
দুর্গার কথা বেদে আছে কি? সকল হিন্দুরই কর্তব্য যে এ কথার অনুসন্ধান করেন। আমরা অদ্য তাঁহাদের এ বিষয়ে কিছু সাহায্য করিব।
অনেকেই জানেন যে বেদ একখানি গ্রন্থ নয়। অথবা চারি বেদ চারিখানি গ্রন্থ মাত্র নহে। কতকগুলিন মন্ত্র, কতকগুলিন “ব্রাহ্মণ” নামক গ্রন্থ, এবং কতকগুলিন উপনিষদ্ লইয়া এক একটি বেদ সম্পূর্ণ। তন্মধ্যে মন্ত্রই বেদের শ্রেষ্ঠাংশ বলা যাইতে পারে।
ইহা একপ্রকার নিশ্চিত যে কোন বৈদিক সংহিতায় এই দেবীর বিশেষ কোন উল্লেখ নাই। ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, বায়ু, সোম, অগ্নি, বিষ্ণু, রুদ্র, অশ্বিনীকুমার প্রভৃতি দেবতার ভূরি ভূরি উল্লেখ ও স্তুতিবাদ আছে; পুষণ, অর্যমন প্রভৃতি এক্ষণে অপরিচিত অনেক দেবতার উল্লেখ আছে, কিন্তু দুর্গা বা কালী বা তাঁহার অন্য কোন নামের বিশেষ উল্লেখ নাই।
ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের অষ্টমাষ্টকে “রাত্রি পরিশিষ্টে” একটি দুর্গা-স্তব আছে মাত্র। কিন্তু তাহাতে যদিও দুর্গা নাম ব্যবহৃত হইয়াছে, তথাপি তাঁহাকে আমাদের পূজিতা দুর্গা বলা যাইতে পারে না। উহা রাত্রি-স্তোত্র মাত্র। সন্দিহান পাঠকের সন্দেহ ভঞ্জনার্থ, আমরা উহা উদ্ধৃত করিলাম।
আরাত্রি পার্থিবং রজঃ পিতুরপ্রায়ি ধামভিঃ।
দিবঃ সদাংসি বৃহতী বিতিষ্ঠসে ত্বেষাং বর্ততে তমঃ || ১ ||
যে তে রাত্রি নৃচাক্ষসো যুক্তাসো নবতির্নব।
অশীতিঃ সন্ত্বষ্টা উতো তে সপ্ত সপ্ততীঃ || ২ ||
রাত্রিং প্রপদ্যে জননীং সর্বভূতনিবেশনীং।
ভদ্রাং ভগবতীং কৃষ্ণাং বিশ্বস্য জগতো নিশাং || ৩ ||