সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকা
যার এই ঈশ্বরভক্তি—যে ঈশ্বরকে এইরূপ সর্বদা নিকটে, অতি নিকটে দেখে—ঈশ্বরসংসর্গতৃষ্ণায় যাহার হৃদয় এইরূপে দগ্ধ—সে কি বিলাসী হইতে পারে? হয় হউক। আমরা এরূপ বিলাসী ছাড়িয়া সন্ন্যাসী দেখিতে চাই না।
তবে ঈশ্বর সন্ন্যাসী, হবিষ্যাশী বা অভোক্তা ছিলেন না। পাঁটা, তপ্সে মাছ, বা আনারসের গুণ গায়িতে ও রসাস্বাদনে, উভয়েই সক্ষম ছিলেন। যদি ইহা বিলাসিতা হয়, তিনি বিলাসী ছিলেন। তাঁহার বিলাসিতা তিনি নিজে স্পষ্ট করিয়া বর্ণনা করিয়াছেন;—
লক্ষ্মীছাড়া যদি হও, খেয়ে আর দিয়ে।
কিছুমাত্র সুখ নাই, হেন লক্ষ্মী নিয়ে ||
যতক্ষণ থাকে ধন, তোমার আগারে।
নিজে খাও, খেতে দাও, সাধ্য অনুসারে ||
ইথে যদি কমলার, মন নাহি সরে
প্যাঁচা লয়ে যান মাতা, কৃপণের ঘরে ||
কিছুমাত্র সুখ নাই, হেন লক্ষ্মী নিয়ে ||
যতক্ষণ থাকে ধন, তোমার আগারে।
নিজে খাও, খেতে দাও, সাধ্য অনুসারে ||
ইথে যদি কমলার, মন নাহি সরে
প্যাঁচা লয়ে যান মাতা, কৃপণের ঘরে ||
শাকান্নমাত্র যে ভোজন না করে, তাহাকেই বিলাসী মধ্যে গণনা করিতে হইবে, ইহাও আমি স্বীকার করি না। গীতায় ভগবদুক্তি এই—
আয়ুঃসত্ত্বলারোগ্য সুখপ্রীতিতবিবর্ধনাঃ।
স্নিগ্ধারস্যাস্থিরাহৃদ্যাঃ আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ।
স্নিগ্ধারস্যাস্থিরাহৃদ্যাঃ আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ।
স্থূল কথা এই, যাহা আগে বলিয়াছি—ঈশ্বর গুপ্ত মেকির বড় শত্রু। মেকি মানুষের শত্রু, এবং মেকি ধর্মের শত্রু। লোভী পরদ্বেষী অথচ হবিষ্যাশী ভণ্ডের ধর্ম তিনি গ্রহণ করেন নাই। ভণ্ডের ধর্মকে ধর্ম বলিয়া তিনি জানিতেন না। তিনি জানিতেন ধর্ম ঈশ্বরানুরাগে, আহার ত্যাগে নহে। যে ধর্মে ঈশ্বরানুরাগ ছাড়িয়া পানাহারত্যাগকে ধর্মের স্থানে খাড়া করিতে চাহিত—তিনি তাহার শত্রু। সেই ধর্মের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ পাঁটার স্তোত্র, আনারসের গুণগানে, এবং তপ্সের মহিমা বর্ণনায় কবির এত সুখ হইত। মানুষটা বুঝিলাম, নিজে ধার্মিক, ধর্মে খাঁটি, মেকির উপর খড়্গহস্ত। ধার্মিকের কবিতায় অশ্লীলতায় কেন দেখি, বোধ হয় তাহা বুঝিয়াছি। বিলাসিতা কেন দেখি, বোধ হয় তাহা এখন বুঝিলাম।
ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার কথা বলিতে বলিতে তাঁহার ব্যঙ্গের কথায়, ব্যঙ্গের কথা হইতে তাঁহার অশ্লীলতার কথায়, অশ্লীলতার কথা হইতে তাঁহার বিলাসিতার কথায় আসিয়া পড়িয়াছিলাম। এখন ফিরিয়া যাইতে হইতেছে।
অশ্লীলতা যেমন তাঁহার কবিতার এক প্রধান দোষ, শব্দাড়ম্বরপ্রিয়তা তেমনি আর এক প্রধান দোষ। শব্দচ্ছটায়, অনুপ্রাস যমকের ঘটায়, তাঁহার ভাবার্থ অনেক সময়ে একেবারে ঘুচিয়া মুছিয়া যায়। অনুপ্রাস যমকের অনুরোধে অর্থের ভিতর কি ছাই ভস্ম থাকিয়া যায়, কবি তাহার প্রতি কিছুমাত্র অনুধাবন করিতেছেন না–দেখিয়া সময়ে রাগ হয়, দুঃখ হয়, হাসি পায়, দয়া হয়, পড়িতে আর প্রবৃত্তি হয় না। যে কারণে তাঁহার অশ্লীলতা, সেই কারণে এই যমকানুপ্রাসে অনুরাগ দেশ কাল পাত্র। সংস্কৃত সাহিত্যের অবনতির সময় হইতে যমকানুপ্রাসের বড় বাড়াবাড়ি। ঈশ্বর গুপ্তের পূর্বেই—কবিওয়ালার কবিতায়, পাঁচালিওয়ালার পাঁচালিতে, ইহার বেশী বাড়াবাড়ি। দাশরথি রায় অনুপ্রাস যমকে বড় পটু—তাই তাঁর পাঁচালি লোকের এত প্রিয় ছিল। দাশরথি রায়ের কবিত্ব না ছিল, এমন নহে, কিন্তু অনুপ্রাস যমকের দৌরাত্ম্যে তাহা প্রায় একেবারে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে ; পাঁচালিওয়ালা ছাড়িয়া তিনি কবির শ্রেণীতে উঠিতে পান নাই। এই অলঙ্কার প্রয়োগে পটুতায় ঈশ্বর গুপ্তের স্থান তার পরে—এত অনুপ্রাস যমক আর কোন বাঙ্গালীতে ব্যবহার করে না। এখানেও মার্জিত রুচির অভাব জন্য বড় দুঃখ হয়।