সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকা
বাবু রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় প্রভৃতির রচনামধ্যে ঈশ্বর গুপ্তের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। কেবল দীনবন্ধুতেই কিয়ৎ-পরিমাণে তাঁহার শিক্ষার চিহ্ন পাওয়া যায়।
“এলোচুলে বেণে বউ আল্তা দিয়ে পায়,
নলক নাকে, কলসী কাঁকে, জল আন্তে যায়।”
নলক নাকে, কলসী কাঁকে, জল আন্তে যায়।”
ইত্যাকার কবিতায় ঈশ্বর গুপ্তকে স্মরণ হয়। বাঙ্গালা সাহিত্যে চারি জন রহস্যপটু লেখকের নাম করা যাইতে পারে,—টেকচাঁদ, হুতোম, ঈশ্বর গুপ্ত এবং দীনবন্ধু। সহজেই বুঝা যায় যে, ইহার মধ্যে দ্বিতীয় প্রথমের শিষ্য এবং চতুর্থ তৃতীয়ের শিষ্য। টেকচাঁদের সহিত হুতোমের যত দূর সাদৃশ্য, ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে দীনবন্ধুর তত সাদৃশ্য না থাকুক, অনেক দূর ছিল। প্রভেদ এই যে, ঈশ্বর গুপ্তের লেখায় ব্যঙ্গ (wit) প্রধান ; দীনবন্ধুর লেখায় হাস্য প্রধান। কিন্তু ব্যঙ্গ এবং হাস্য উভয়বিধ রচনায় দুই জনেই পটু ছিলেন,—তুল্য পটু ছিলেন না। হাস্যরসে ঈশ্বর গুপ্ত দীনবন্ধুর সমকক্ষ নহেন।
আমি যতদূর জানি, দীনবন্ধুর প্রথম রচনা “মানব-চরিত্র”—নামক একটি কবিতা। ঈশ্বর গুপ্ত কর্তৃক সম্পাদিত “সাধুরঞ্জন”—নামক সাপ্তাহিক পত্রে উহা প্রকাশিত হয়। অতি অল্প বয়সের লেখা, এজন্য ঐ কবিতায় অনুপ্রাসের অত্যন্ত আড়ম্বর। ইহাও, বোধ হয়, ঈশ্বর গুপ্তের প্রদত্ত শিক্ষার ফল। অন্যে ঐ কবিতা পাঠ করিয়া কিরূপ বোধ করিয়াছিলেন বলিতে পারি না, কিন্তু উহা আমাকে অত্যন্ত মোহিত করিয়াছিল। আমি ঐ কবিতা আদ্যোপান্ত কণ্ঠস্থ করিয়াছিলাম এবং যত দিন সেই সংখ্যার সাধুরঞ্জনখানি জীর্ণগলিত না হইয়াছিল, তত দিন উহাকে ত্যাগ করি নাই। সে প্রায় সাতাইশ বৎসর হইল ; এই কাল মধ্যে ঐ কবিতা আর কখন দেখি নাই ; কিন্তু ঐ কবিতা আমাকে এমনই মন্ত্রমুগ্ধ করিয়াছিল যে, অদ্যাপি তাহার কোন কোন অংশ স্মরণ করিয়া বলিতে পারি। পাঠকগণের ঐ কবিতা দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা নাই, কেন না, উহা কখন পুনর্মুদ্রিত হয় নাই। অনেকেই দীনবন্ধুর প্রথম রচনার দুই এক পঙ্ক্তি শুনিলেও প্রীত হইতে পারেন ; এজন্য স্মৃতির উপর নির্ভর করিয়া ঐ কবিতা হইতে দুই পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করিলাম। ইহার আরম্ভ এইরূপ—
মানব-চরিত্র-ক্ষেত্রে নেত্র নিক্ষেপিয়া।
দুঃখানলে দহে দেহ, বিদরয়ে হিয়া ||
একটি কবিতা এই
যে দোষে সরস হয় সে জনে সরস।
যে দোষে বিরস হয় সে জনে বিরস ||
আর একটি
যে নয়নে রেণু অণু অসি অনুমান।
বায়সে হানিবে তায় তীক্ষ্ণ চঞ্চু-বাণ ||
ইত্যাদি
সেই অবধি, দীনবন্ধু মধ্যে মধ্যে প্রভাকরে কবিতা লিখিতেন। তাঁহার প্রণীত কবিতা সকল পাঠ-সমাজে আদৃত হইত। তিনি সেই তরুণ বয়সে যে কবিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাঁহার অসাধারণ “সুরধুনী” কাব্য এবং “দ্বাদশ কবিতা” সেই পরিচয়ানুরূপ হয় নাই। তিনি দুই বৎসর, জামাই-ষষ্টীর সময়ে, “জামাই-ষষ্টী” নামে দুইটি কবিতা লেখেন। এই দুইটি কবিতা বিশেষ প্রশংসিত এবং আগ্রহাতিশয্যের সহিত পঠিত হইয়াছিল। দ্বিতীয় বৎসরের “জামাই-ষষ্টী” যে সংখ্যক প্রভাকরে প্রকাশিত হয়, তাহা পুনর্মুদ্রিত করিতে হইয়াছিল। সেই সকল কবিতা যেরূপ প্রশংসিত হইয়াছিল, “সুরধুনী” কাব্য এবং “দ্বাদশ কবিতা” সেরূপ প্রশংসিত হয় না। তাহার কারণ সহজেই বুঝা যায়। হাস্যরসে দীনবন্ধুর অদ্বিতীয় ক্ষমতা ছিল। “জামাই-ষষ্টী”তে হাস্যরস প্রধান। সুরধুনী কাব্যে ও দ্বাদশ কবিতায় হাস্যরসের আশ্রয় মাত্র নাই। প্রভাকরে দীনবন্ধু যে সকল কবিতা লিখিয়াছিলেন, তাহা পুনর্মুদ্রিত হইলে বিশেষরূপে আদৃত হইবার সম্ভাবনা।