বেদের ঈশ্বরবাদ

প্রবাদ আছে হিন্দুদিগের তেত্রিশ কোটি দেবতা, কিন্তু বেদে বলে মোটে তেত্রিশটি দেবতা। এ সম্বন্ধে আমরা প্রথম প্রবন্ধে যে সকল ঋক্ উদ্ধৃত করিয়াছি, পাঠক তাহা স্মরণ করুন। আমরা দেখিয়াছি, বেদে বলে এই তেত্রিশটি দেবতা তিন শ্রেণীভুক্ত ; এগারটি আকাশে, এগারটি অন্তরিক্ষে, এগারটি পৃথিবীতে।

ইহাতে যাস্ক কি বলেন শুনা যাউক। তিনি অতি প্রাচীন নিরুক্তকার-আধুনিক ইউরোপীয় পণ্ডিত নহেন। তিনি বলেন,

“তিস্র এব দেবতা ইতি নৈরুক্তাঃ। অগ্নিঃ পৃথিবীস্থানো বায়ুর্বা ইন্দ্র বা অন্তরিক্ষস্থানঃ সূর্য্যো দ্যুস্থানঃ। তাসাং মহাভাগ্যাদ্ একৈকস্যাপি বহূনি নামধেয়ানি ভবন্ত। অপি বা কর্ম্মপৃথক্‌ত্বাৎ যথা হোতা অধ্বর্য্যুর্ব্রহ্মা উদ্গাতা ইত্যস্যেকস্য সতঃ।” ৭।৫।

অর্থাৎ “নৈরুক্তদিগের মতে বেদের দেবতা তিন জন। পৃথিবীতে অগ্নি, অন্তরিক্ষে ইন্দ্র বা বায়ু এবং আকাশে সূর্য্য। তাঁহাদের মহাভাগত্ব কারণ এক এক জনের অনেকগুলি নাম। অথবা তাঁহাদিগের কর্ম্মের পার্থক্য জন্য, যথা হোতা, অধ্বর্য্যু, ব্রহ্মা, উদ্গাতা, এক জনেরই নাম হয়।

তেত্রিশ কোটির স্থানে গোড়ায় তেত্রিশ পাইয়াছিলাম, এখন নিরুক্তের মতে, তেত্রিশের স্থানে মোটে তিন জন দেখিতেছি-অগ্নি, বায়ু বা ইন্দ্র, এবং সূর্য্য। বহুসংখ্যক পৃথক্ পৃথক্ চৈতন্য দ্বারা যে জগৎ শাসিত হয় না-জাগতিকী শক্তি এক, বহুবিধা নহে, পৃথিবীতে সর্ব্বত্র এক নিয়মের শাসন, অন্তরিক্ষে সর্ব্বত্র এক নিয়মের শাসন, এবং আকাশে সর্ব্বত্র এক নিয়মের শাসন এখন তাঁহারা দেখিতেছেন। পৃথিবীতে আর এগারটি পৃথক্ দেবতা নাই-এক দেবতা, তাঁহার কর্ম্মভেদে অনেক নাম, কিন্তু বস্তুতঃ তিনি এক, অনেক দেবতা নহেন। তেমনি অন্তরিক্ষেও এক দেবতা, আকাশেও এক দেবতা।

এখনও প্রকাশ পাইতেছে না যে, ঋষিরা জাগতিক শক্তির সম্পূ‍র্ণ ঐক্য অনুভূত করিয়াছেন। এখন পৃথিবীর এক দেবতা, অন্তরিক্ষের অন্য দেবতা, আকাশের তৃতীয় দেবতা। জীব, উদ্ভিদাদির উৎপত্তি ও রক্ষা হইতে বায়ু বৃষ্টি প্রভৃতি অন্তরিক্ষের ক্রিয়া এত ভিন্নপ্রকৃতি, আবার সে সকল হইতে আলোকাদি আকাশব্যাপার সকল এত ভিন্ন যে, এই তিনের ঐক্য এবং একনিয়মাধীনত্ব অনুভূত করা আরও কালসাপেক্ষ। কিন্তু অসীম প্রতিভাসম্পন্ন বৈদিক ঋষিদিগের নিকট তাহাও অধিক দিন অস্পষ্ট থাকে নাই। ঋগ্বেদসংহিতাতেই পাওয়া যায়, “মূর্দ্ধা ভূবো ভবতি নক্তমগ্নিস্ততঃ সূর্য্যো জায়তে প্রাতরুদ্যন্।” (১০-৮৮) “অগ্নি রাত্রে পৃথিবীর মস্তকব ; প্রাতে তিনি সূর্য্য হইয়া উদয় হন।” পুনশ্চ “যদেনমদধুর্য্যজ্ঞিয়াসে দিবি দেবাঃ সূর্য্যমাদিতেয়ম্।” ইহাতে “এনং অগ্নিং সূর্য্যং আদিতেয়ং” ইত্যাদি বাক্যে অগ্নিই সূর্য্য বুঝাইতেছে।র্দ্ধা

এই সূক্তের ব্যাখ্যায় যাস্ক বলেন, “ত্রেধা ভাবায় পৃথিব্যামন্তরিক্ষে দিবি ইতি শাকপূণিঃ” অর্থাৎ শাকপূণি (পূর্ব্বগামী নিরুক্তকার) বলিয়াছেন যে, “পৃথিবীতে, অন্তরিক্ষে, এবং আকাশে তিন স্থানে অগ্নি আছেন।” ভৌম, অন্তরিক্ষ, ও দিব্য, এই ত্রিবিধ দেবই তবে অগ্নি।

অগ্নি সম্বন্ধে এইরূপ আরও অনেক কথা পাওয়া যায়। ক্রমে জগতের একশক্ত্যধীনত্ব ঋষিদিগের মনে আরও স্পষ্ট হইয়া আসিতেছে। “ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহুরথো দিব্যং স সুপর্ণো গুরুত্মান্। একং সদ্বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি অগ্নিং যমং মাতরিশ্বানং।” ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি বল, বা দিব্য সম্পূর্ণ গুরুত্মান্ বল, এক জনকেই বিপ্তগণে অনেক বলেন, যথা, “অগ্নি যম মাতরিশ্বন্।” পুনশ্চ, অথর্ব্ব বেদে, “স বরুণঃ সায়মগ্নির্ভবতি স মিত্রো ভবতি প্রাতরুদ্যন্। স সবিতা ভূত্বা অন্তরিক্ষেণ যাতি, স ইন্দ্রো ভূত্বা তপতি মধ্যতো দিবং” সেই অগ্নিই সায়ংকালে বরুণ হয়েন। তিনিই প্রাতঃকালে উদয় হইয়া মিত্র হয়েন। তিনিই সবিতা হইয়া অন্তরিক্ষে গমন করেন, এবং ইন্দ্র হইয়া মধ্যাকাশে তাপ বিকাশ করেন।