ভগবদ্বাক্যের যাথার্থ্য এবং সার্ব্বজনীনতার প্রমাণস্বরূপ পরবর্ত্তী দেশী বিদেশী ইতিহাস হইতে তিনটি উদাহরণ প্রয়োগ করিব।

প্রথম, রাজার স্বধর্ম্ম-রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন। তিনি ধর্ম্মপ্রচারক বা ধর্ম্মনিয়ন্তা নহেন। এখানে Religion অর্থে ধর্ম্ম শব্দ ব্যবহার করিতেছি। কিন্তু মধ্যকালে ইউরোপে রাজগণ ধর্ম্মনিয়ন্তৃত্ব গ্রহণ করায় মনুষ্যজাতির কি ভয়ানক অমঙ্গল ঘটিয়াছিল, তাহা ইতিহাসে সুপরিচিত। উদাহরণস্বরূপ St. Bartholomew, Sicilian Vespers এবং স্পেনের Inquisition, এই তিনটি নামের উত্থাপনই যথেষ্ট। কথিত আছে, পঞ্চম চার্লসের সময়ে এক Netherland দেশে দশ লক্ষ মনুষ্য কেবল রাজার ধর্ম্ম হইতে ভিন্নধর্ম্মাবলম্বী বলিয়া প্রাণে নিহত হইয়াছিল। আজকাল ইংরেজরাজ্যে ভারতবর্ষে রাজার এরূপ পরধর্ম্মাবলম্বন প্রবৃত্তি থাকিলে ভারতবর্ষে কয় জন হিন্দু থাকিত?

দ্বিতীয় উদাহরণ, বাঙ্গালা দেশে ইংরেজরাজত্বের প্রথম সময়ে। রাজার ধর্ম্ম ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম। বাণিজ্য বৈশ্যের ধর্ম্ম। রাজা এই সময়ে বৈশ্যধর্ম্মাবলম্বন করিয়াছিলেন-East India Company বাণিজ্যব্যবসায়ী হইয়াছিলেন। ইহার ফল ঘটিয়াছিল বাঙ্গালার শিল্পনাশ, বাণিজ্যনাশ, অর্থনাশ। বাঙ্গালার কার্পাসবস্ত্র, পট্টবস্ত্র, রেশম, পিত্তল, কাঁসা, সব ধ্বংসপুরে গেল;-আভ্যন্তরিক বাণিজ্য কতক একেবারে অন্তর্হিত হইল, কতক অন্যের হাতে গেল; বাঙ্গালা এমন দারিদ্র্য-সমুদ্রে ডুবিল যে, আর উঠিল না। কোম্পানিকেও শেষ বাণিজ্য ছাড়িতে হইল। মানুষ সব ছাড়ে, আফিঙ্গ ছাড়ে না। সে বাণিজ্যেরও এখনও আফিঙ্গটুকু আছে।

তৃতীয় উদাহরণ, আমেরিকার স্ত্রীজাতির আধুনিক স্বধর্ম্মত্যাগে ও পৌরুষ কর্ম্মে প্রবৃত্তি। ইহাতে ঘটিতেছে, স্ত্রীজাতির বৈষয়িক ভিন্ন প্রকার অবনতি, গৃহে উচ্ছৃঙ্খলতা এবং জাতীয় সুখহানি। যে স্ত্রীলোক স্বগর্ভসম্ভূত শিশুকে স্তন্যদানে অসমর্থা, তাহাকে স্মরণ করিয়া, সহমরণাভিলাষিণী হিন্দুমহিলা অবশ্যই বলিবেন,

স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ।
ধূমেনাব্রিয়তো বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ।
যথোল্বেণাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্ || ৩৮ ||

যেমন ধূমে বহ্নি আবৃত, মলে দর্পণ এবং গর্ভ জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই কামের দ্বারা (জ্ঞান) আবৃত থাকে। ৩৮।

“জ্ঞান” শব্দটি মূলে নাই,-তৎপরিবর্ত্তে “ইদম্” আছে। কিন্তু পরশ্লোকে “জ্ঞান” শব্দই আবৃতের বিশেষ্য; এ জন্য এ শ্লোকের অনুবাদেও সেইরূপ করা গেল।

৩৩ শ্লোকে কথিত হইয়াছে যে, জ্ঞানবান্‌ও আপন প্রকৃতির অনুরূপ চেষ্টা করে।

“সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি”

জ্ঞানবান্ জ্ঞান থাকিতে কেন এরূপ করে? তাহাই বুঝাইবার জন্য বলিতেছেন যে, জ্ঞান এই কামের দ্বারা আবৃত থাকে; জ্ঞান এ অবস্থায় অকর্ম্মণ্য হয়।

উপমা তিনটি অতি চমৎকার; কিন্তু উপমার কৌশল বুঝাইবার পূর্ব্বে বলা আবশ্যক। “মল” শব্দে শঙ্করাচার্য্য “মল” অর্থাৎ মলই বুঝিয়াছেন। কিন্তু শ্রীধর স্বামী বলেন, “মলেন” কি না “আগন্তুকেন”। এ অবস্থায় দর্পণস্থ প্রতিবিম্ব যে “মল” শব্দের অভিপ্রেত, ইহাই বুঝিতে হইতেছে।

উপমা তিনটির প্রতি দৃষ্টি করা যাউক। যাহা উপমিত, এবং যাহা উপমেয়, উভয়ই স্বাভাবিক। বহ্নির স্বাভাবিক আবরণ ধূম; দর্পণ থাকিলেই ছায়া বা প্রতিবিম্ব থাকিবে, নহিলে দর্পণত্ব নাই; এবং গর্ভেরও স্বাভাবিক আবরণ জরায়ু। তেমনই জ্ঞানের আবরণ কামও স্বাভাবিক। ইহা পূর্ব্বেই কথিত আছে। উপমেয় ও উপমিত উভয়ই প্রকাশাত্মক; বহ্নি প্রকাশাত্মক; দর্পণ প্রকাশাত্মক, গর্ভ প্রকাশাত্মক;-তেমনই জ্ঞানও প্রকাশাত্মক। প্রকাশের জন্য প্রয়োজন, ক্রিয়াবিশেষ। ফুৎকারাদির দ্বারা ধূমাবরণ, অপসারণের দ্বারা বিম্বাবরণ এবং প্রসবের দ্বারা উল্বণাবরণ বিনষ্ট হইয়া অগ্নি, দর্পণ, ও গর্ভের প্রকাশ হয়, তেমনই ইন্দ্রিয় দমনের দ্বারা কামাবরণ বিনষ্ট হইয়া জ্ঞানের প্রকাশ পায়। ইহা ৪১ শ্লোকে দেখিব।