দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম
এই সূক্তের তাৎপর্য্য বড় স্পষ্ট। পূর্ব্বে বুঝান গিয়াছে, ইন্দ্র বর্ষণকারী আকাশ। বৃত্র বৃষ্টিনিরোধকারী নৈসর্গিক ব্যাপার। বর্ষণশক্তির দ্বারা সেই সকল নৈসর্গিক ব্যাপার অপহত হইলে বৃত্রবধ হইল। এই সূক্ত বর্ষণকারী আকাশের সেই ক্রিয়ার প্রশংসা মাত্র। ইন্দ্র এখানে কোন চেতনাবিশিষ্ট পুরুষ নহেন, এবং এ সূক্তে তাহার কোন সকাম উপাসনাও নাই।
স্বীকার করি, এক্ষণে বৈদিক সংহিতায় যে উপাসনা আছে, তাহার প্রায় অধিকাংশই সকাম, এবং উপাস্যেরা তাহাতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেবতা বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু জড়শক্তির প্রশংসা-পদ্ধতি ক্রমে প্রচলিত হইয়া আসিলে, শব্দের আড়ম্বরে তাহার প্রকৃত তাৎপর্য্য লোকের চিত্ত হইতে অপসৃত হইল। “জগতের রাজা,” এবং “জীবগণের অধীশ্বর” ইত্যাকার বাক্যের যথার্থ তাৎপর্য্য যে, বৃষ্টি হইতেই জগৎ ও জীবের রক্ষা, লোকে ইহা ক্রমে ভুলিয়া যাইতে লাগিল, এবং ইন্দ্রকে যথার্থ জগতের চৈতন্যবিশিষ্ট রাজা এবং জীবগণের চৈতন্যবিশিষ্ট অধীশ্বর মনে করিতে লাগিল। তখন জগতের জড়শক্তির নিষ্কাম প্রশংসার স্থানে সকাম উপাসনা আসিয়া উপস্থিত হইল। যাহা চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তিগুলির অনুশীলন মাত্র ছিল, তাহা দেবতাবহুল উপধর্ম্মে পরিণত হইল।
বৈদিক ধর্ম্মের উৎপত্তি কি তাহা উপরি উদ্ধৃত অপেক্ষাকৃত প্রাচীন সূক্তগুলি হইতেই আমরা বুঝিতে পারি। ঋগ্বেদ-সংহিতার সকল সূক্তগুলি এক সময়ে প্রণীত হয় নাই ; এবং ঋগ্বেদের সর্ব্বত্র বহু দেবতার উপসানাত্মক উপধর্ম্মই যে আছে, এমত নহে। অনেকগুলি এমত সূক্ত আছে যে, তাহা হইতে আমরা একেশ্বরবাদই শিক্ষা করি। সময়ান্তরে আমরা তাহার আলোচনা করিব। সেইগুলি যে বৈদিক ধর্ম্মের অপেক্ষাকৃত শেষাবস্থায়, আর উপরি উদ্ধৃত সূক্তের সদৃশ সূক্তগুলি যে আদিম অবস্থায় আর সচেতন ইন্দ্রাদির উপাসনাত্মক সূক্তগুলি প্রধানতঃ যে মধ্যাবস্থায় প্রণীত হইয়াছিল, ইহা যে মনোযোগপূর্ব্বক বেদাধ্যয়ন করিবে সেই বুঝিতে পারিবে। বেদব্যাস, বেদ বিভাগ করিয়াছিলেন। সঙ্কলন ব্যতীত চতুর্ব্বেদের বিভাগ হয় নাই। যাহা সঙ্কলিত, তাহা নানা ব্যক্তির দ্বারা নানা সময়ে প্রণীত হইয়াছিল। অতএব, আদিম, মধ্যকালিক, এবং শেষাবস্থার সূক্ত বলিয়া সূক্তগুলিকে বিভাগ করা যাইতে পারে। ধর্ম্মের প্রথমাবস্থা জড় প্রশংসা, মধ্যকালে চৈতন্যবাদ, এবং পরিণতি একেশ্বরবাদে। অতএব সূক্তের তাৎপর্য্য বুঝিয়া তাহার সময় নির্দ্দেশ করা যায়।
এক্ষণে ‘প্রচারে’র দ্বিতীয় সংখ্যা হইতে এ পর্য্যন্ত বৈদিক দেবতাতত্ত্ব সম্বন্ধে যাহা বলিলাম পাঠক তাহা স্মরণ করুন। তাহার স্থূল তাৎপর্য্যে এই;-
১। ইন্দ্রাদি বৈদিক দেবতা, আকাশ, সূর্য্যে, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি জড়ের বিকাশ ভিন্ন কোন লোকোত্তর চৈতন্য নহে।
২। এই সকল দেবতাদিগের উপাসনা যেমন বেদে আছে, সেইরূপ ভারতবর্ষ ভিন্ন অন্যান্য দেশে ছিল বা আছে।
৩। তাহার কারণ এই যে, প্রথমাবস্থায় মনুষ্য জড়ে চৈতন্য আরোপণ করিয়া তাহার শক্তি, হিতকারিতা, বা সৌন্দর্য্য অনুসারে তাহার উপাসনা করে।
৪। এই উপাসনা গোড়ায় কেবল শক্তিমান, সুন্দর বা উপকারী জড়পদার্থের প্রশংসা বা আদর মাত্র। কালে লোকে সে কথা ভুলিয়া গেলে, ইহা ইতর দেবতার উপাসনায় পরিণত হয়।
হিন্দুধর্ম্মে ইতর দেবোপসনা এই অবস্থায় পরিণত হইয়াছে। ঈদৃশ উপাসনা অনিষ্টকর এবং উপধর্ম্ম। কিন্তু ইহার মূল অনিষ্টকর নহে। জড়শক্তিও ঈশ্বরের শক্তি। সে সকলের আলোচনার দ্বারা ঈশ্বরের মহিমা এবং কৃপা অনুভূত করা এবং তদ্দ্বারা চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তি সকলের অনুশীলন করা বিধেয় বটে।
বৈদিক ধর্ম্মের এই স্থূল তাৎপর্য্য। আধুনিক হিন্দুধর্ম্মেও সেই সকল বৈদিক দেবতারা উপাসিত। অতএব এখনকার হিন্দুধর্ম্মের সংস্কারে সেই কথা আমাদের মনে রাখা উচিত। জড়ের শক্তির চিন্তার দ্বারা জ্ঞানার্জ্জনী এবং চিত্তরঞ্জিনীবৃত্তি সকলের অনুশীলন করিব, এবং ঈশ্বরের মহিমা বুঝিবার চেষ্টা করিব, কিন্তু জড়ের উপাসনা করিব না। ইহাই হিন্দুধর্ম্মের একটি স্থূল কথা।
এক্ষণে বৈদিক তত্ত্বান্তর্গত দেবতাতত্ত্ব সমাপ্ত করিয়া, আমরা বৈদিক তত্ত্বান্তর্গত ঈশ্বরতত্ত্বের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইতে পারি। হিন্দুধর্ম্মের এই ব্যাখ্যার প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত করিলাম।-‘প্রচার’, ১ম বর্ষ, পৃ. ৩৯৭-৪০৭।