চন্দ্রশেখর
শৈবলিনী হাত যোড় করিয়া কহিল, “বাচাল স্ত্রীলোককে মার্জনা করুন—এখন লোক পাঠাইলে ধরা যায় না কি?”
ন। ইংরেজদিগকে ধরা অল্প লোকের কর্ম নহে। অধিক লোক সশস্ত্রে পাঠাইতে হইলে, বড় নৌকা চাই। ধরিতে ধরিতে তাহারা মুরশিদাবাদ পৌঁছিবে। বিশেষ যুদ্ধের উদ্যোগ দেখিয়া, কি জানি যদি ইংরাজেরা আগে বন্দীদিগকে মারিয়া ফেলে। মুরশিদাবাদে সুচতুর কর্মচারীসকল আছে, তাহারা কলেকৌশলে ধরিবে।
শৈবলিনী বুঝিল যে, তাঁহার সুন্দর মুখখানিতে অনেক উপকার হইয়াছে। নবাব তাঁহার সুন্দর মুখখানি দেখিয়া, তাঁহার সকল কথা বিশ্বাস করিয়াছেন, এবং তাঁহার প্রতি বিশেষ দয়া প্রকাশ করিতেছেন। নহিলে এত কথা বুঝাইয়া বলিবেন কেন? শৈবলিনী সাহস পাইয়া আবার হাত যোড় করিল। বলিল, “যদি এ অনাথাকে এত দয়া করিয়াছেন, তবে আর একটি ভিক্ষা মার্জনা করুন। আমার স্বামীর উদ্ধার অতি সহজ—তিনি স্বয়ং বীরপুরুষ। তাঁহার হাতে অস্ত্র থাকিলে তাঁহাকে ইংরেজ কয়েদ করিতে পারিত না—তিনি যদি এখন হাতিয়ার পান, তবে তাঁহাকে কেহ কয়েদ রাখিতে পারিবে না। যদি কেহ তাঁহাকে অস্ত্র দিয়া আসিতে পারে, তবে তিনি স্বয়ং মুক্ত হইতে পারিবেন, সঙ্গীদিগকে মুক্ত করিতে পারিবেন।”
নবাব হাসিলেন, বলিলেন, “তুমি বালিকা, ইংরেজ কি, তাহা জান না। কে তাঁহাকে সে ইংরেজের নৌকায় উঠিয়া অস্ত্র দিয়া আসিবে?”
শৈবলিনী মুখ নত করিয়া, অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “যদি হুকুম হয়, যদি নৌকা পাই, তবে আমিই যাইব ।”
নবাব উচ্চহাস্য করিলেন। হাসি শুনিয়া শৈবলিনী ভ্রূ কুঞ্চিত করিল, বলিল, “প্রভু! না পারি আমি মরিব—তাহাতে কাহারও ক্ষতি নাই। কিন্তু যদি পারি, তবে আমারও কার্যসিদ্ধি হইবে, আপনারও কার্যসিদ্ধি হইবে।”
নবাব শৈবলিনীর কুঞ্চিত ভ্রূশোভিত মুখমণ্ডল দেখিয়া বুঝিলেন, এ সামান্যা স্ত্রীলোক নহে। ভাবিলেন, “মরে মরুক, আমার ক্ষতি কি? যদি পারে ভালই—নহিলে মুরশিদাবাদে মহম্মদ তকি কার্যসিদ্ধি করিবে।” শৈবলিনীকে বলিলেন, “তুমি কি একাই যাইবে?”
শৈ। স্ত্রীলোক, একা যাইতে পারিব না। যদি দয়া করেন, তবে একজন দাসী, একজন রক্ষক, আজ্ঞা করিয়া দিন।
নবাব, চিন্তা করিয়া মসীবুদ্দীন নামে একজন বিশ্বাসী, বলিষ্ঠ এবং সাহসী খোজাকে ডাকাইলেন। সে আসিয়া প্রণত হইল, নবাব তাহাকে বলিলেন, “এই স্ত্রীলোককে সঙ্গে লও। এবং একজন হিন্দু বাঁদী সঙ্গে লও। ইনি যে হাতিয়ার লইতে বলেন, তাহাও লও। নৌকার দারোগার নিকট হইতে একখানি দ্রুতগামী ছিপ লও। এই সকল লইয়া, এইক্ষণেই মুরশিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা কর।”
মসীবুদ্দীন জিজ্ঞাসা করিল, “কোন্ কার্য উদ্ধার করিতে হইবে?”
ন। ইনি যাহা বলিবেন, তাহাই করিবে। বেগমদিগের মত ইঁহাকে মান্য করিবে। যদি দলনী বেগমের সাক্ষাৎ পাও, সঙ্গে লইয়া আসিবে।
পরে উভয়ে নবাবকে যথারীতি অভিবাদন করিয়া, বিদায় হইল। খোজা যেরূপ করিল, শৈবলিনী দেখিয়া, দেখিয়া, সেইরূপ মাটি ছুঁইয়া পিছু হটিয়া সেলাম করিল। নবাব হাসিলেন।
নবাব গমনকালে বলিলেন, “বিবি, স্মরণ রাখিও। কখন যদি মুস্কিলে পড়, তবে মীরকাসেমের কাছে আসিও।”
শৈবলিনী পুনর্বার সেলাম করিল। মনে মনে বলিল, “আসিব বৈ কি? হয়ত রূপসীর সঙ্গে স্বামী লইয়া দরবার করিবার জন্য তোমার কাছে আসিব।”
মসীবুদ্দীন পরিচারিকা ও নৌকা সংগ্রহ করিল। এবং শৈবলিনীর কথামত বন্দুক, গুলি, বারুদ, পিস্তল, তরবারি ও ছুরি সংগ্রহ করিল। মসীবুদ্দীন সাহস করিযা জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না যে, এ সকল কি হইবে। মনে মনে কহিল যে, এ দোসরা চাঁদ সুলতানা।
সেই রাত্রেই তাহারা নৌকারোহণ করিয়া যাত্রা করিল।