অর্থাৎ তাহাদিগকে কর্ম্মফলকামনা পরিত্যাগ করিতে বলিলে, তাহা তাহারা পারিবে না। তবে উপদেশ বা দৃষ্টান্তের ফলে এমত ঘটিতে পারে যে, তাহারা সকাম কর্ম্ম পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিবে। সকাম কর্ম্ম অভ্যস্ত না হইলে, নিষ্কাম কর্ম্ম সম্ভবে না; এই জন্য তাহাদিগের বুদ্ধি বিচালিত করা বা বুদ্ধিভেদ জন্মান নিষিদ্ধ হইতেছে।

ময়ি সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।
নিরাশীনির্ম্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ || ৩০ ||

আমাতে সমস্ত কর্ম্ম সমর্পণ করিয়া অধ্যাত্ম-জ্ঞানের দ্বারা নিস্পৃহ মমতাশূন্য ও শোকশূন্য হইয়া যুদ্ধ কর। ৩০।

গোড়ার কথাটা এই হইয়াছিল যে, অর্জ্জুন আত্মীয় স্বজনকে হত্যা করিয়া তাদৃশ পাপকর্ম্মের দ্বারা রাজ্য লাভ করিতে অনিচ্ছুক; অতএব যুদ্ধ করিবেন না স্থির করিলেন। তদুত্তরে ভগবান্ প্রথমে আত্মজ্ঞানে তাঁহাকে উপদিষ্ট করিলেন। তার পর কর্ম্মের মাহাত্ম্য ও অবশ্যকর্ত্তব্যতা বুঝাইলেন। বুঝাইলেন যে, সকলকে কর্ম্ম করিতেই হয়।অন্য কর্ম্ম না করিলেও জীবনযাত্রা নির্ব্বাহের জন্য কর্ম্ম করিতে হয়। তবে যাহার আত্মজ্ঞান নাই, সে মূর্খ ফলকামনা করিয়া কর্ম্ম করে, আর যে আত্মজ্ঞানী, সে নিষ্কাম হইয়া কর্ম্ম করে; কিন্তু নিষ্কাম হইয়াই হউক, আর সকাম হইয়াই হউক, অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম করিতেই হইবে। যদি করিতেই হইল, তবে নিষ্কাম হইয়া করাই ভাল; কেন না, নিষ্কাম কর্ম্মই পরম ধর্ম্ম। অতএব তুমি নিষ্কাম হইয়া, ফলকামনা পরিত্যাগ করিয়া, রাজ্যলাভ হইবে, না হইবে, সে চিন্তা না করিয়া, কর্ম্মের ফলাফল ঈশ্বরে অর্পণ করিয়া, যুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম বলিয়া নির্ব্বিকারচিত্তে যুদ্ধ কর।

যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।
শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেহপি কর্ম্মভিঃ || ৩১ ||

যে সকল মনুষ্য শ্রদ্ধাবান্ ও অসূয়াশূন্য হইয়া আমার এই মতের নিত্য অনুষ্ঠান করে, তাহারা কর্ম্ম হইতে অর্থাৎ কর্ম্মফলভোগ হইতে মুক্ত হয়। ৩১।

যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্ত্যো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্।
সর্ব্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ || ৩২ ||

যাহারা অসূয়াপরবশ হইয়া আমার এই মতের অনুষ্ঠান করে না, তাহাদিগকে সর্ব্বজ্ঞানবিমূঢ়, বিনষ্ট এবং বিবেকশূন্য বলিয়া জানিও। ৩২।

সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি।
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি || ৩৩ ||

জ্ঞানবান্‌ও, যাহা আপন প্রকৃতির অনুকূল, সেইরূপই চেষ্টা করে। জীবগণ প্রকৃতিরই অনুগামী হয়। নিগ্রহে কোন ফল হয় না। ৩৩।

ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ।
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেত্তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ || ৩৪ ||

ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে ইন্দ্রিয়ের রাগদ্বেষ অবশ্যম্ভাবী। তাহার বশগামী হইও না; কেন না, তাহা শ্রেয়োমার্গের বিঘ্নকারক। ৩৪।

শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ || ৩৫ ||

পরধর্ম্মের সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান অপেক্ষা স্বধর্ম্মের অসম্পূর্ণ অনুষ্ঠানও ভাল। বরং স্বধর্ম্মে নিধনও ভাল, পরধর্ম্ম ভয়াবহ। ৩৫।