পক্ষান্তরে ইহাও বলা যাইতে পারে যে, প্রসবিতৃ শব্দ ঋগ্বেদে সূর্য্য প্রতিও এক স্থানে প্রযুক্ত হইয়াছে (৭।৬৩।২।)। ঋগ্বেদের সূক্তের একটি লক্ষণ এই যে, যখন যে দেবতা স্তুত হন, তখন তিনিই সকলের বড় হইয়া দাড়ান। সুতরাং সবিতার এত মাহাত্ম্য কীর্ত্তিত দেখিয়াও কিছুই স্থির করা যায় না। সবিতা যে সূর্য্য, এমত বিবেচনা করিবার অনেকগুলি কারণ আছে।

১। ঋগ্বেদে অনেক স্থানে স্পষ্টই সূর্য্যার্থে সবিতৃ শব্দ প্রযুক্ত হইয়াছে। যথা, ৪ ম, ১৪ সূ, ২ ঋকে।

২। সূর্য্যের ন্যায় তাঁহার রূপ। সূর্য্যের মত তাঁহার কিরণ আছে। (প্রসুবন্নক্তুভির্জগৎ। ৪ম, ৫৩ সূ, ৩ ঋক্) সূর্য্যের ন্যায় তাঁহার রথ আছে, অশ্ব আছে এবং সূর্য্যের ন্যায় তিনি আকাশ পরিভ্রমণ করেন।

৩। যাস্ক বলেন, যখন আকাশ হইতে অন্ধকার গিয়াছে, রশ্মি বিকীর্ণ হইয়াছে, সেই সবিতার কাল।# সায়নাচার্য্য বলেন যে, উদয়ের পূর্ব্বে যে মূর্ত্তি সেই সবিতা, উদয় হইতে অস্ত পর্য্যন্ত যে মূর্ত্তি, সেই সূর্য্য।†† অতএব এই মত পূর্ব্ব পণ্ডিতগণ কর্ত্তৃক গৃহীত।

৪। সবিতা যে পরব্রহ্ম নহেন, তাহার আর এক প্রমাণ এই যে, পরব্রহ্মবাদীরা ঈশ্বরকে নিরাকার বলিয়াই স্বীকার করেন, অথবা বিশ্বরূপ বলিয়া থাকেন, কিন্তু সবিতা অন্যান্য বৈদিক দেবতার ন্যায় সাকার। তিনি হিরণ্যাক্ষ্য, হিরণ্যহস্ত, হিরণজিহ্ব, হিরণ্যপাণি, পৃথুপাণি, সুপাণি, সুজিহ্ব, মন্দ্রজিহ্ব, হরিকেশ ইত্যাদি শব্দে বর্ণিত হইয়াছেন। তাঁহার বাহুর কথা অনেক বার কথিত হইয়াছে। (বাহু, কর মাত্র)।

বোধ হয় এখন স্বীকার করিতে হইবে যে, সবিতা, পরব্রহ্ম নহেন, জড়পিণ্ড সূর্য্য। তবে গায়ত্রীর সেই “তৎসবিতুঃ” শব্দের অর্থ কি হইল? এত কাল কি ব্রাহ্মণেরা গায়ত্রীতে সূর্য্যকেই ডাকিয়া আসিতেছে, পরব্রহ্মকে নয়? যে গায়ত্রী না জপিয়া ব্রাহ্মণকে জলগ্রহণ করিতে নাই, যে গায়ত্রী জপ করিয়া ব্রাহ্মণ মনে করেন, আমি পবিত্র হইলাম, আমার সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইল-সে কি কেবল জড়পিণ্ড সূর্য্যের কথা, জগদীশ্বরের নহে?

ব্রাহ্মণে এমন ভাবে না। এমন ভাবিতে ব্রাহ্মণের প্রাণে বড় আঘাত লাগে। ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্মপক্ষে গায়ত্রীর কিরূপ অর্থ করেন, তাহার উদাহরণস্বরূপ মহামহোপাধ্যায় রঘুনন্দন ভট্টাচার্য্যের কৃত ব্যাখ্যা নোটে উদ্ধৃত করিলাম।* কিন্তু এখনকার ব্রাহ্মণেরা যাই বলুন, এইরূপ ব্যাখ্যাই কি প্রকৃত ব্যাখ্যা? গায়ত্রী সামগ্রীটা কি, তাহা বুঝিলেই গোল মিটিতে পারে।

গায়ত্রী আর কিছুই নহে। ঋগ্বেদের একটি ঋক্। তৃতীয় মণ্ডলে দ্বিষষ্টিতম সূক্তের ১৮টি ঋক আছে ; তন্মধ্যে দশম ঋক্ গায়ত্রী। ঐ সূক্তটি সমুদায় উদ্ধৃত করিতে হইতেছে, নহিলে পাঠক “গায়ত্রীর” মর্ম্ম বুঝিবেন না।

এই সূক্তের ঋষি বিশ্বামিত্র। ইন্দ্রাবরুণৌ (ইন্দ্র ও বরুণ একত্রে) বৃহস্পতি, পূষা, সবিতা, সোম, মিত্রাবরুণৌ (মিত্র ও বরুণ একত্রে) এই সূক্তের দেবতা। অর্থাৎ বিশ্বামিত্র এই সূক্তে বক্তা (প্রণেতা) এবং ইন্দ্রাদি দেবতা ইহাতে স্তুত হইয়াছেন। ঐ স্তুত দেবতাদিগের মধ্যে সবিতা এক জন। যে ঋক্‌‌টিকে গায়ত্রী বলা যায়, তাহা তাঁহারই স্তব।

# তস্য কালো যদা দ্যৌরপহততমস্কাকীর্ণরশ্মির্ভবতি।
†† উদয়াৎ পূর্ব্বভাষী সবিতা। উদয়াস্তমধ্যবর্ত্তী সূর্য্য ইতি। * “গায়ত্র্যা অর্থমাহ যোগী যাজ্ঞবল্ক্য:। দেবস্য সবিতুর্বর্চ্চো ভর্গমন্তর্গতং বিভুং। ব্রহ্মবাদিন এবাহুর্ব্বরণ্যেঞ্চাস্য ধীমহি। চিন্তয়ামো বয়ং ভর্গং ধিয়ো যো ন: প্রচোদয়াৎ। ধর্ম্মার্থকামমোক্ষেষু বুদ্ধিবৃত্তী: পুন: পুন:। বুদ্ধেশ্চেদয়িতা যস্তু চিদাত্মা পুরুষো বিরাট্। বরণ্যেং বরণীয়ঞ্চ জন্মসংসারভীরুভি:। আদিত্যান্তর্গতং যচ্চ ভর্গাখ্যংতন্মুমুক্ষভি:। জন্মমৃত্যুবিনাশায় দু:খস্য ত্রিয়তস্য চ। ধ্যানেন পুরুষো যশ্চ দ্রষ্টব্য: সূর্য্যমণ্ডলে। মন্ত্রার্থমপি চৈবায়ং জ্ঞাপয়ত্যেবমেবহি। তেন গায়ত্র্যা অয়মর্থ:। দেবস্য সবিতুর্ভগস্বরূপান্তর্য্যামি ব্রহ্ম বরেণ্যং বরণীয়ং জন্মমৃত্যুভীরুভি: তদ্বিনাশায় উপাসনীয়ং। ধীমহি প্রাগুক্তেন সোহহস্মীত্যনেন চিন্তায়াম:, যো ভর্গ: সর্ব্বান্তর্য্যামীশ্বরো নোহস্মাকং সর্ব্বেষাং সংসারিণং ধিয়ো বুদ্ধী: প্রচোদয়াৎ ধর্ম্মার্থকামমোক্ষেষু প্রেরয়তি। তথাচ ভগবদ্‌গীতায়াং। “ঈশর: সর্ব্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জ্জুন তিষ্ঠতি, ভ্রাময়ন্ সর্ব্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া।” ঈশ্বরোহন্তর্য্যামী হৃদ্দেশে অন্ত:করণে ভ্রাময়ন্ তত্তৎকর্ম্মসু প্রেরয়ন্ দারুযন্ত্রতুল্যশরীরারূঢ়ানি ভূতানি প্রাণিনো জীবানিতি যাবৎ মায়য়া অঘটনঘটনপটীয়স্যা নিজশক্তা। তথাচাশ্বতরাণাং মন্ত্র:। “একো দেব: সর্ব্বভূতেষু গূঢ় সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বভূতান্তরাত্মা। কর্ম্মাধ্যক্ষ: সর্ব্বভূতাধিবাস: সাক্ষী চেতা কেবলো নির্গুণশ্চ।”