দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম
বরুণাদি#
আমরা বলিয়াছি, ইন্দ্র ও অদিতি আকাশ-দেবতা। বরুণ আর একটি আকাশ-দেবতা। বৃ ধাতু আবরণে। যাহা চরাচর বিশ্ব আবরণ করিয়া আছে, তাহাই বরুণ। আকাশকে যখন অনন্ত ভাবি, তখন তিনি অদিতি, যখন আকাশকে বৃষ্টিকারী ভাবি, তখন আকাশ ইন্দ্র, যখন আকাশকে সর্ব্বাবরণকারী ভাবি, তখন আকাশ বরুণ।
পুরাণে বরুণ আর আকাশ-দেবতা নহেন, তিনি জলেশ্বর। ঋগ্বেদেও তিনি স্থানে স্থানে জলাধিপতি বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। তাহার কারণ, বেদে পৃথিবীর বায়বীয় আবরণ অনেক স্থলে জল বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে।† কিন্তু প্রাচীন কালে তিনি যে আকাশ-দেবতা ছিলেন, গ্রীকদিগের মধ্যে Ouranos দেবতা তাহার এক প্রমাণ। ভাষাতত্ত্ববিৎ পাঠকেরা অবগত আছেন যে গ্রীক ও হিন্দুরা এক বংশসম্ভূত, তাহার অনুল্লঙ্ঘ্য প্রমাণ আছে। গ্রীক ধর্ম্মে Ouranos দেবতা।
ঋগ্বেদে বরুণের বড় প্রধান্য। তিনি সচরাচর সম্রাট্ ও রাজা বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। ইউরোপীয় পণ্ডিত কেহ কেহ বলেন যে, প্রথমে বরুণ বৈদিক উপাসকদিগের প্রধান দেবতা ছিলেন, ক্রমে ইন্দ্র তাঁহাকে স্থানচ্যুত করিয়াছেন। ফলতঃ ঋগ্বেদে বরুণের যেরূপ মাহাত্মা কীর্ত্তিত হইয়াছে, এরূপ ইন্দ্র ভিন্ন আর কোন দেবতারই হয় নাই। পৌরাণিক বরুণ ক্ষুদ্র দেবতা।
আর এক আকাশ-দেবতা “দ্যৌঃ”। ভাষাতত্ত্ববিদেরা বলেন, ইনি গ্রীকদিগের “Zeus” এবং “Zeus Pater” হইয়া রোমকদিগের Jupiter হইয়াছেন। Zeus ও Jupiter উক্ত জাতিদিগের প্রধান দেবতা। “দ্যৌঃ” এককালে আর্য্যদিগের প্রধান দেবতা ছিলেন। ইঁহাকে বেদে প্রায় পৃথিবীর সঙ্গে একত্রে পাওয়া যায়। যুক্তনাম “দ্যাবা পৃথিবী”। দ্যৌঃ পিতা-পৃথিবীর মাতা। ইঁহাদিগের সম্বন্ধে কয়েকটা কথা ভবিষ্যতে বলিবার আছে। ইঁহারা যে আকাশ ও পৃথিবী ইঁহাদের নামেই প্রকাশ আছে, অন্য প্রমাণ দিতে হইবে না।
আর একটি আকাশ-দেবতা পর্জ্জন্য। ইনিও ইন্দ্রের ন্যায় বৃষ্টি করেন, বজ্রপাত করেন, ভূমিকে শস্যশালিনী করেন। ইন্দ্রের সঙ্গে ইঁহার প্রভেদ কেন হইল, তাহা আমি বুঝিতে পারি নাই, বুঝাইতেও পারিলাম না। তবে ইহা বুঝিতে পারি যে, পর্জ্জন্য ইন্দ্রের অপেক্ষা প্রাচীন দেবতা। লিথুয়ানিয়া বলিয়া রুষ দেশের একটি ক্ষুদ্র বিভাগ আছে। সে প্রদেশের লোক আর্য্যবংশোদ্ভব। শুনিয়াছি তাহাদের ভাষার সঙ্গে প্রাচীন বেদের ভাষার বিশেষ সাদৃশ্য। এমন কি, বেদজ্ঞ ব্যক্তি তাহাদের ভাষা অনেক বুঝিতে পারেন। এই পর্জ্জন্যদেব, সেই প্রদেশে আজিও বিরাজ করিতেছেন। সেখানে নাম Perkunas. সেখানেও তিনি বজ্রবৃষ্টির দেবতা। যদি এ কথা সত্য হয়, তবে যে আদিম আর্য্যজাতি, ইউরোপীয় ও ভারতবর্ষীয় আধুনিক আর্য্যজাতিদিগের পূর্ব্বপুরুষ, পর্জ্জন্য তাঁহাদিগের দেবতা। ইন্দ্রের নাম ভারতবর্ষ ভিন্ন আর কোথাও নাই। ইনি কেবল ভারতবর্ষীয় দেবতা। আর্য্যেরা ভারতবর্ষে আসিলে তবে ইঁহার সৃষ্টি হইয়াছিল। ইন্দ্র পর্জ্জন্যের অনেক পরবর্ত্তী।
# এই প্রবন্ধ পড়িবার আগে, ইহার পূর্ব্বস্থিত প্রবন্ধটি পড়িলে ভাল হয়।
† যথা “যে দেবাসো দিবি একাদশ স্থ পৃথিব্যামধি একাদশ স্থ। অপ্সুক্ষিতো মহিনা একাদশ স্থ তে দেবাসো” ইত্যাদি। ১, ১৩৯, ১১।
† যথা “যে দেবাসো দিবি একাদশ স্থ পৃথিব্যামধি একাদশ স্থ। অপ্সুক্ষিতো মহিনা একাদশ স্থ তে দেবাসো” ইত্যাদি। ১, ১৩৯, ১১।