শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
“সহযজ্ঞ” অর্থাৎ কর্ম্মাধিকারী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যকে সম্বোধন করিয়া প্রজাপতি যাহা বলিয়াছেন, তাহাতে কাম্য কর্ম্মেরই উদ্ঘোষণা হইল। কিন্তু “মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূঃ” এই বচনে কাম্য কর্ম্মের নিষেধও করা হইয়াছে, এবং গীতাতেও কাম্য কর্ম্মের প্রসঙ্গ নাই, এজন্য ব্রহ্মার উক্তি এ স্থলে নিতান্ত অসঙ্গত বলিয়া বোধ হইতেছে; কিন্তু বিচার করিয়া দেখিলে এ আশঙ্কা বিদূরিত হইবে। “প্রজাগণ, তোমরা কামনা করিয়া ফলপ্রাপ্তির জন্য যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিও”- ব্রহ্মা এ কথা বলেন নাই। কর্ত্তব্যানুরোধে কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিবে, ইহাই ব্রহ্মার উদ্দেশ্য। কিন্তু এই কর্ম্মসাধন মধ্যে যে দিব্য শক্তি নিহিত আছে, তাহারই ঘোষণার্থ ব্রহ্মা বলিলেন, “তোমরা নিয়মিত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিও। তাহারই অলৌকিক প্রভাবে তোমরা যখন যাহা বাসনা করিবে, তাহা সিদ্ধ হইতে থাকিবে। লোকে আম্রেরই জন্য যেমন আম্রবৃক্ষ রোপণ করে, কিন্তু ছায়া ও মুকুলের সদ্গন্ধ তাহারা বিনা চেষ্টাতেই পাইয়া থাকে, সেইরূপ কর্ত্তব্যের অনুরোধেই কর্ম্ম সাধন করিবে, কিন্তু অনুষ্ঠানের ফল কামনা না করিলেও, উহা স্বতএব প্রাপ্ত হইবে। ফলে ইচ্ছা না থাকিলেও কর্ম্মের স্বভাবগুণেই ফল উৎপন্ন হইয়া থাকে।”
আমার বোধ হয়, আমার পাঠকের নিকট শঙ্কর ও শ্রীধরের উত্তরের ন্যায়, এ উত্তরও সন্তোষজনক হইবে না। কিন্তু বিচারে বা প্রতিবাদে আমার কোন প্রয়োজন নাই। এই সাতটি শ্লোকের ভিতর একটি রহস্য আছে, দেখাইয়া দিয়া ক্ষান্ত হইব।
গীতাকার বলিতেছেন যে-
সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ।70
এই কথা গীতাকার নিজে হইতে বলেন নাই। এইরূপ বিশ্বাস প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল। মনুসংহিতায় আছে,
কর্ম্মাত্মনাঞ্চ দেবানাং সোহসৃজৎ প্রাণিনাং প্রভুঃ।
সাধ্যানাঞ্চ গণং সূক্ষ্মং যজ্ঞষ্ণ্বৈব সনাতনম্ ||
১-২২। ইত্যাদি।
সাধ্যানাঞ্চ গণং সূক্ষ্মং যজ্ঞষ্ণ্বৈব সনাতনম্ ||
১-২২। ইত্যাদি।
যজ্ঞের দ্বারা দেবগণ পরিতুষ্ট ও প্রসন্ন হয়েন, এবং যজ্ঞকারীকে অভিমত ফল দান করেন, ইহা বৈদিক ধর্ম্মের স্থূলাংশ। ইহাই লৌকিক ধর্ম্ম।
এখন পূর্ব্বপ্রচলিত প্রাচীন লৌকিক ধর্ম্মের প্রতি ধর্ম্মসংস্কারকের কিরূপ আচরণ করা কর্ত্তব্য? এমন লৌকিক ধর্ম্মে নাই, এবং হইতেও পারে না যে, তাহাতে উপধর্ম্মের কোনও সম্বন্ধ নাই। যিনি ধর্ম্মসংস্করণে প্রবৃত্ত, তিনি সেই লৌকিক বিশ্বাসভুক্ত উপধর্ম্মের প্রতি কিরূপ আচরণ করিবেন?
কেহ কেহ বলেন, তাহার একেবারে উচ্ছেদ কর্ত্তব্য। মহম্মদ তাহাই করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার ও তাঁহার পরবর্ত্তী মহাপুরুষগণের তরবারির জোর তত বেশী না থাকিলে, তিনি কৃতকার্য্য হইতে পারিতেন না। যীশুখ্রীষ্ট নিজে যীহুদা ধর্ম্মের উপরেই আপনার প্রচারিত ধর্ম্মতত্ত্ব সংস্থাপিত করিয়াছিলেন। তার পর খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম যে রোমক সাম্রাজ্য হইতে প্রাচীন উপ ধর্ম্মকে একেবারে দূরীকৃত করিয়াছিল, তাহার একমাত্র কারণ এই যে, রোমক সাম্রাজ্যের প্রাচীন ধর্ম্ম তখন একেবারে জীবনশূন্য হইয়াছিল। যাহা জীবনশূন্য, তাহার মৃত দেহটা ফেলিয়া দেওয়া বড় কঠিন কাজ নহে। পক্ষান্তরে শাক্যসিংহের ধর্ম্ম, প্রাচীন ধর্ম্মের সঙ্গে কখনও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় নাই।
গীতাকারও বৈদিক ধর্ম্মের প্রতি খড়্গহস্ত নহেন। তিনি জানিতেন যে, তাঁহার কথিত নিষ্কাম কর্ম্মযোগ ও জ্ঞানযোগ কখনও লৌকিক ধর্ম্মের সমস্ত স্থান অধিকার করিতে পারিবে না। তবে লৌকিক ধর্ম্ম বজায় থাকিলে, ইহার দ্বারা প্রকৃষ্টরূপে সেই লৌকিক ধর্ম্মের বিশুদ্ধিসাধন হইতে পারিবে। এ জন্য তিনি সম্বন্ধবিচ্ছেদ করিতে ইচ্ছুক নহেন। যাঁহারা বৈদিক ধর্ম্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে তাঁহাকে আমরা গণনা করিয়াছি। কিন্তু তাঁহার কৃত যে বিদ্রোহ, তাহার সীমা এই পর্য্যন্ত যে, বেদে ধর্ম্ম আছে, তাহা অসম্পূর্ণ; নিষ্কাম কর্ম্মযোগাদির দ্বারা তাহা সম্পূর্ণ করিতে হইবে। এই জন্য তিনি বৈদিক সকাম ধর্ম্মকে নিকৃষ্ট বলিয়াছেন। কিন্তু নিকৃষ্ট বলিয়া যে তাহার কোনও প্রকার গুণ নাই, এমন কথা বলেন নাই। তাহার গুণ সম্বন্ধে এখানে গীতাকার যাহা বলেন, বুঝাইতেছি।
70 ইহার অনুবাদ পূর্ব্বে দেওয়া হইয়াছে।