কোন্ পথে যাইতেছি?

যাঁহারা ধর্ম্ম-ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত, তাঁহাদিগকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। এক শ্রেণীর ব্যাখ্যাকারেরা বলেন, যাহাকে ধর্ম্ম বলিতেছি, তাহা ঈশ্বরোক্ত বা ঈশ্বর-প্রেরিত উপদেশ। তাঁহাদের কাজ বড় সোজা। অমুক গ্রন্থে ঈশ্বরদত্ত উপদেশগুলি পাওয়া যায়, আর তাহার তাৎপর্য্য এই, এই কথা বলিলেই তাহাদের কাজ ফুরাইল। খ্রীষ্টিয়ান, ব্রাহ্মণ, মুসলমান, য়ীহুদী, সচরাচর এই প্রথাই অবলম্বন করিয়াছেন।

দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যাখ্যাকারেরা বলেন যে, কোন ধর্ম্ম বা ধর্ম্মপুস্তক যে ঈশ্বরোক্ত, ইহা বিশ্বাস করিবার উপযুক্ত কারণ নাই। বৌদ্ধ, কোম্‌ত্, ব্রাহ্ম, এবং নব্য হিন্দু ব্যাখ্যাকারেরা এই মতের উদাহরণস্বরূপ। ইঁহারা কোন গ্রন্থকেই ঈশ্বরোক্তি বলিয়া স্বীকার করেন না। যদি ঈশ্বর-প্রণীত ধর্ম্ম না স্বীকার করিলেন, তবে তাহাদিগকে ধর্ম্মের একটা নৈসর্গিক ভিত্তি আছে, ইহা প্রমাণ করিতে হইবে। নইলে ধর্ম্মের কোন মূল থাকে না-কিসের উপর ধর্ম্ম সংস্থাপিত হইবে? ধর্ম্মের এই নৈসর্গিক ভিত্তি কল্পিত অস্তিত্বশূন্য বস্তু নহে ; যাঁহারা ঈশ্বরপ্রণীত ধর্ম্ম স্বীকার করিয়া থাকেন, তাঁহারাও ধর্ম্মের নৈসর্গিক ভিত্তি স্বীকার করিতে পারেন।

উপস্থিত লেখক হিন্দুধর্ম্মের অন্যান্য নূতন ব্যাখ্যাকারদিগের ন্যায় দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত। আমি কোন ধর্ম্মকে ঈশ্বর-প্রণীত বা ঈশ্বর প্রেরিত মনে করি না।* ধর্ম্মের নৈসর্গিক ভিত্তি আছে, ইহাই স্বীকার করি। অথচ স্বীকার করি যে, সকল ধর্ম্মের অপেক্ষা হিন্দুধর্ম্ম শ্রেষ্ঠ।

এই দুইটি কথা একত্রিত করিলে, পাঠক প্রথমে আপত্তি করিবেন যে, এই দুইটি উক্তি পরস্পর অসঙ্গত, হিন্দুধর্ম্মের যাহারা গ্রহণ করে, তাহারা হিন্দুধর্ম্ম ঈশ্বরোক্ত বলিয়াই গ্রহণ করে। কেন না, হিন্দুধর্ম্ম বেদমূলক। বেদ হয় ঈশ্বরোক্ত, নয় ঈশ্বরের ন্যায় নিত্য। যে ইহা মানিল না, সে আবার হিন্দুধর্ম্মের সত্যতা এবং শ্রেষ্টতা স্বীকার করে কি প্রকারে?

ইহার উত্তরে বলা যাইতে পারে যে, ধর্ম্মের যে নৈসর্গিক ভিত্তি আছে হিন্দুধর্ম্ম তাহার উপর স্থাপিত, তাই ঈশ্বর-প্রণীত ধর্ম্ম না মানিয়াও হিন্দুধর্ম্মের যাথার্থ্য ও শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করা যাইতে পারে। মহাত্মা রজা রামমোহন রায়ের সময় হইতে এই কথা ক্রমে পরিস্ফুট হইতেছে।

যাঁহারা এই কথা বলেন, তাঁহাদের উপর এই কথা প্রমাণের ভার আছে। তাঁহাদিগকে দেখাইতে হইবে যে, হিন্দুধর্ম্ম, ধর্ম্মের নৈসর্গিক মূলের উপর স্থাপিত। যদি তাহা না দেখাইতে পারেন, তবে এক শ্রেণীর লোক বলিবেন, “হিন্দুধর্ম্ম তবে ধর্ম্মেই নহে, মিথ্যা ধর্ম্ম।” আর এক শ্রেণীর লোক বলিবেন, “ধর্ম্মের নৈসর্গিক ভিত্তির কথা ছাড়িয়া দাও-বেদ নিত্য বা বিধিবাক্য বলিয়া স্বীকার কর।”

অতএব হিন্দুধর্ম্মের ব্যাখ্যায় আমাদের দেখাইতে হইবে যে, হিন্দুধর্ম্ম, ধর্ম্মের নৈসর্গিক ভিত্তির উপর স্থাপিত। ইহা দেখাইতে গেলে প্রথমে বুঝাইতে হইবে, ধর্ম্মের সেই নৈসর্গিক মূল কি? তাহার পর দেখাইতে হইবে যে, হিন্দুধর্ম্ম সেই মূলের উপরেই স্থাপিত।

* যাহা কিছু জগতে আছে, তাহাই ঈশ্বর-প্রণীত বা ঈশ্বর-প্রেরিত। সে কথা এখন হইতেছে না।