এই প্রথম সূক্তের ঋষি মধুচ্ছন্দা। তার পর দেবতা অগ্নি। সূক্তের দেবতা কি? যেমন ঋষি শব্দের আলোচনায় তাহার লৌকিক অর্থ উড়িয়া গেল তেমনি দেবতা শব্দের আলোচনায় ঐরূপ দেবতার লৌকিক অর্থ উড়িয়া যায়। নিরুক্তকার বলেন যে, “যস্য বাক্যং স ঋষিঃ যা তেনোচ্যতে সা দেবতা” অর্থাৎ সূক্তে যাহার কথা থাকে, সেই সে সূক্তের দেবতা। অর্থাৎ সূক্তের যা “Subject” তাই দেবতা।

ইহাতে অনেকে এমন কথা বলিতে পারেন, এক্ষণে যাহাদিগকে দেবতা বলি, অর্থাৎ ইন্দ্রাদি, সূক্ত সকলে তাঁহারাই স্তুত হইয়াছেন, অতএব এখন যে অর্থে তাঁহারা দেবতা, সেই অর্থেই তাঁহারা বেদমন্ত্রে দেবতা। এরূপ আপত্তি যে হইতে পারে না, তাহার প্রমাণ দানস্তুতিসকল। কতকগুলি সূক্ত আছে, সেগুলিকে দানস্তুতি বলে। তাহাতে কোন দেবতারই প্রশংসা নাই, কেবল দানেরই প্রশংসা আছে। অতএব ঐ সকল সূক্তের দানই দেবতা। ইহা অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, যদি দেবতা শব্দের অর্থ সূক্তের বিষয় (subject), তবে দেবতার আধুনিক অর্থ আসিল কোথা হইতে? এ তত্ত্ব বুঝিবার জন্য দেবতা শব্দটি একটু তলাইয়া বুঝিতে হইবে। নিরুক্তকার যাস্ক বলিয়াছেন, “যো দেবঃ সা দেবতা” যাহাকে দেব বলে, তাহাকেই দেবতা বলা যায়। এই দেব শব্দের উৎপত্তি দেখ। দিব্ ধাতু হইতে দেব। দিব্ দীপনে বা দ্যোতনে। যাহা উজ্জ্বল, তাহাই দেব। আকাশ, সূর্য্য, অগ্নি, চন্দ্র প্রভৃতি উজ্জ্বল, এই জন্য এ সকল আদৌ দেব। এ সকল মহিমাময় বস্তু, এই জন্য আদৌ ইহাদের প্রশংসায় স্তোত্র, অর্থাৎ সূক্ত রচিত হইয়াছিল। কালে যাহার প্রশংসায় সূক্ত রচিত হইতে লাগিল তাহাই দেব হইল। পর্জ্জন্য যিনি বৃষ্টি করেন। তিনি উজ্জ্বল নহেন, তিনিও দেব হইলেন। ইন্দ্ ধাতু বর্ষণে। সংস্কৃতে একটি র প্রত্যয় আছে। রুদ্ ধাতুর পর র করিয়া রুদ্র হয়, অসু ধাতুর পর র করিয়া অসুর হয়। ইন্দ্ ধাতুর পর র করিয়া ইন্দ্র হয়। অতএব যিনি বৃষ্টি করেন, তিনিই ইন্দ্র। যিনি বৃষ্টি করেন তাঁহাকে উজ্জ্বল বলিয়া মনে কল্পনা করিতে পারি না, কিন্তু তিনি ক্ষমতাবান্-বৃষ্টি না হইলে শস্য হয় না, শস্য না হইলে লোকের প্রাণ বাঁচে না। কাজেই তিনিও বৈদিক সূক্তে স্তুত হইলেন। বৈদিক সূক্তে স্তুত হইলেন বলিয়াই তিনি দেবতা হইলেন। এ সকল কথার সবিস্তার প্রমাণ ক্রমে পাওয়া যাইবে।

“ঋষির্মধুচ্ছন্দা। অগ্নিদেবতা। গায়ত্রীচ্ছন্দাঃ।” ছন্দ বুঝিতে কাহারও দেরী হইবে না। কেন না, ছন্দ ইংরাজি বাঙ্গালাতে আছে। ঋক্‌গুলি পদ্য, কাজেই ছন্দে বিন্যস্ত। “যদক্ষরপরিমাণং তচ্ছন্দঃ।” অক্ষর পরিমাণকে ছন্দ বলে। চৌদ্দ অক্ষরে পয়ার হয়-পয়ার একটি ছন্দ। আমাদের যেমন পয়ার, ত্রিপদী, চতুষ্পদী, নানা রকম ছন্দ আছে, বেদেও তেমনি গায়ত্রী অনুষ্টুভ্, ত্রিষ্টুভ্, বৃহতী, পংক্তি প্রভৃতি নানাবিধ ছন্দ আছে। যে সূক্ত যে ছন্দে রচিত,-আমরা যাহাকে “হেডিং” বলিয়াছি, তাহাতে দেবতা ও ঋষির পর ছন্দের নাম কথিত থাকে। যাঁহারা মাইকেল দত্ত ও হেমচন্দ্রের পূর্ব্বকার কবিদিগের কাব্য পড়িয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, এ প্রথা বাঙ্গালা রচনাতেও ছিল। আগে বিষয় অর্থাৎ দেবতা লিখিত হইত, যথা-“গণেশ-বন্দনা।” তাহার পর ছন্দ লিখিত হইত, যথা “ত্রিপদী ছন্দ” বা “পয়ার।” শেষে ঋষি লিখিত হইত, যথা-“কাশীরাম দাস কহে” কি “কহে রায় গুণাকর।” ইংরাজিতেও দেবতা ও ঋষি লিখিতে হয়; ছন্দ লিখিত হয় না। যথা, De Profundis দেবতা Alfred Tennyson ঋষি।

ঋষি দেবতা ও ছন্দের পর বিনিয়োগ। যে কাজের জন্য সূক্তটির প্রয়োজন, অথবা যে কাজে উহা ব্যবহার হইবে, তাহাই বিনিয়োগ। যথা, অগ্নিষ্টোমে বিনিয়োগঃ অর্থাৎ অগ্নিষ্টোম যজ্ঞে ইহার নিয়োগ বা ব্যবহার। অতএব ইংরাজিতে বুঝাইতে হইলে বুঝাইব যে, ঋষি (author) দেবতা (subject) ছন্দ (metre) বিনিয়োগ (use).

এক্ষণে আমরা ঋক্‌টি উদ্ধৃত করিতে পারি।