শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
পুনশ্চ লৌকিক বিশ্বাসের পর নির্ভর করিয়া বলিতেছেন,-
দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ || ১১ ||
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ || ১১ ||
তোমার যজ্ঞের দ্বারা দেবতাদিগকে সংবর্দ্ধিত কর; দেবগণ তোমাদিগকে সংবর্দ্ধিত করুন। পরস্পর এইরূপ সংবর্দ্ধিত করিযা পরম শ্রেয়ঃ লাভ করিবে। ১১।
টীকায় শ্রীধর স্বামী বলেন, “তোমরা হবির্ভাগের দ্বারা দেবগণকে সংবর্দ্ধিত করিবে, দেবগণও বৃষ্ট্যাদির দ্বারা অন্নোৎপত্তি করিয়া তোমাদিগকে সংবর্দ্ধিত করিবেন”। আমরা ত অন্ন না খাইলে বাঁচি না, ইহা জানা আছে। দেবতারাও না কি যজ্ঞের ঘি খাইয়া থাকেন, খাইলে তাঁহাদের পুষ্টিসাধন হয়। বেদে এরূপ কথা আছে। থাকুক।
ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যতে যজ্ঞভাবিতাঃ।
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙ্ক্তে স্তেন এব সঃ || ১২ ||
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙ্ক্তে স্তেন এব সঃ || ১২ ||
যজ্ঞের দ্বারা সংবর্দ্ধিত দেবগণ, যে অভীষ্ট ভোগ তোমাদিগকে দিবেন, তাঁহাদিগকে তদ্দত্ত (অন্ন) না দিয়া, যে খায়, সে চোর। ১২।
শঙ্কর ও শ্রীধর স্বামী বলেন, (বলিবার বিশেষ প্রয়োজন দেখা যায় না) “পঞ্চযজ্ঞাদিভিরদত্ত্বা”, পঞ্চযজ্ঞাদির দ্বারা না দিয়া খায়, সে চোর। পঞ্চ যজ্ঞ যথা।
অধ্যাপনং ব্রহ্মযজ্ঞঃ পিতৃযজ্ঞস্তু তর্পণম্।
হোমো দৈবো বলির্ভৌতো নৃযজ্ঞোহতিথিভোজনম্ ||
হোমো দৈবো বলির্ভৌতো নৃযজ্ঞোহতিথিভোজনম্ ||
অর্থাৎ ব্রহ্মযজ্ঞ বা অধ্যাপন, পিতৃযজ্ঞ বা তর্পণ, দৈব যজ্ঞ বা হোম, ভূতযজ্ঞ বা বলি, এবং নরযজ্ঞ বা অতিথি-ভোজন। ইহা স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য যে, শ্রীধর “পঞ্চযজ্ঞৈরদত্ত্বা” বলেন না, “পঞ্চযজ্ঞাদিভিরদত্ত্বা” বলেন।
যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্ব্বকিল্বিযৈঃ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ || ১৩ ||
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ || ১৩ ||
যে সজ্জনগণ যজ্ঞাবশিষ্ট ভোজন করেন, তাঁহারা সর্ব্বপাপ হইতে মুক্ত হয়েন। যাহারা কেবল আপনার জন্য পাক করে, সেই পাপিষ্ঠেরা পাপ ভোজন করে। ১৩।
অন্নাদ্ভবন্তি ভূতানি পর্জ্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।
যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জ্জন্যো যজ্ঞঃ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ || ১৪ ||
যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জ্জন্যো যজ্ঞঃ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ || ১৪ ||
অন্ন হইতে ভূতসকল উৎপন্ন; পর্জ্জন্য হইতে অন্ন জন্মে; যজ্ঞ হইতে পর্জ্জন্য জন্মে। কর্ম্ম হইতে যজ্ঞের উৎপত্তি। ১৪।
পর্জ্জন্য একটি বৈদিক দেবতা। তিনি বৃষ্টি করেন। এখানে পর্জ্জন্য অর্থে বৃষ্টি বুঝিলেই হইবে।
অন্ন হইতে জীবের উৎপত্তি। কথাটা ঠিক বৈজ্ঞানিক না হউক, অসত্য নয় এবং বোধগম্য বলে। টীকাকারেরা বুঝাইয়াছেন, অন্ন রূপান্তরে শত্রু শোণিত হয়, তাহা হইতে জীব জন্মে। ইহাই যথেষ্ট।
তার পর বৃষ্টি হইতে অন্ন। তাহাও স্বীকার করা যাইতে পারে; কেন না, বৃষ্টি না হইলে ফসল হয় না। কিন্তু যজ্ঞ হইতে বৃষ্টি এ কথাটা বৈজ্ঞানিক স্বীকার করিবেন না। টীকাকারেরা বলেন, যজ্ঞের ধূমে মেঘ জন্মে। অন্য ধূমেও মেঘ জন্মিতে পারে। অধিকাংশ মেঘ ধূম ব্যতীত জন্মে। যে দেশে যজ্ঞ হয় না, সে দেশেও মেঘ ও বৃষ্টি হয়। সে যাহা হউক, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এ স্থলে আলোচিত হইতেছে না। তবে কি ভগবদুক্তি অসত্য ও অবৈজ্ঞানিক? ক্রমশঃ তাহাই বুঝাইতেছি।
কর্ম্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্ব্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ || ১৫ ||
তস্মাৎ সর্ব্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ || ১৫ ||
কর্ম্ম ব্রহ্ম হইতে উদ্ভূত জানিও; ব্রহ্ম অক্ষর হইতে সমুদ্ভূত; অতএব সর্ব্বগত ব্রহ্ম নিত্য যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত। ১৫।