দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম
ইহার উত্তরে অনেকে বলিবেন যে, এ ব্যক্তি হিন্দুশাস্ত্রবিহিত আচারবান্ নহে, এজন্য এ হিন্দু নহে। কোথায় এ হিন্দুধর্ম্মের স্বরূপ পাইব?
এ সকল লোকের বিশ্বাস যে, হিন্দুশাস্ত্রেই হিন্দুধর্ম্ম আছে। এই হিন্দুশাস্ত্র কি? শাস্ত্র তো অনেক। যে সকল গ্রন্থকে শাস্ত্র বলা যায়, তাহার যেখানে যাহা আছে সকলই কি হিন্দুধর্ম্ম? যদি কোন গ্রন্থ হিন্দুশাস্ত্র বলিয়া এ দেশে মান্য হয়, তবে সে ‘মনুসংহিতা’। মনুতে আছে যে, যুদ্ধকালে শত্রুসেনা যে তড়াগপুষ্করিণ্যাদির জলে স্নান পানাদি করে, তাহা নষ্ট করিবে।* যে হিন্দুধর্ম্মে তৃষিতকে এক গণ্ডূষ জলদানের অপেক্ষা আর পুণ্য নাই বলে, সেই হিন্দুধর্ম্মেরই এই গ্রন্থে বলিতেছে যে, সহস্র সহস্র লোককে জলপীপাসাপীড়িত করিয়া প্রাণে মারিবে। এটা কি হিন্দুধর্ম্ম? যদি হয়, তবে এরূপ নৃশংস ধর্ম্মের পুনর্জ্জীবনে কি ফল? বস্তুতঃ এ হিন্দুধর্ম্ম নহে, যুদ্ধনীতি মাত্র, -কি উপায়ে যুদ্ধে জয়লাভ করিতে পারা যায়, তদ্বিষয়ক উপদেশ। ইহা হিন্দুধর্ম্ম হয়, তবে এ হিন্দুধর্ম্মে মন্বাদি অপেক্ষা মোল্ত্কে ও নেপোলিয়ন্ অধিক অভিজ্ঞ।
স্থূল কথা এই, মনুতে যাহা কিছু আছে, তাহাই যে ধর্ম্ম নহে, ইহা এক উদাহরণেই সিদ্ধ হইতেছে। এ সকলকে যদি ধর্ম্ম বলা যায়, তবে সে ধর্ম্ম শব্দের অপব্যবহার। যখন বলি, চোরের ধর্ম্ম লুকোচুরি, তখন যেমন ধর্ম্ম শব্দ অর্থান্তরে প্রযুক্ত হয়, এ সকল বিধিকে “রাজধর্ম্ম” ইত্যাদি বলা, সেইরূপ। তবে মনুতে যাহা যাহা পাই, তাহাই যদি ধর্ম্ম নহে, তবে জিজ্ঞাস্য, মনুর কোন্ উক্তিগুলিতে হিন্দুধর্ম্ম আছে এবং কোন্গুলিতে নাই, এ কথা কে মীমাংসা করিবে? যদি মন্বাদি ঋষিরা অভ্রান্ত হন, তবে তাঁহাদের সকল উক্তিগুলিই ধর্ম্ম-যদি তাহাই ধর্ম্ম হয়, তবে ইহা মুক্তকণ্ঠে বলা যাইতে পারে যে, হিন্দুধর্ম্মানুসারে সমাজ চলা অসাধ্য। মনু হইতেই একটা উদাহরণ দিয়া আমরা দেখাইতেছি। মনে কর, কাহারও পিতৃশ্রাদ্ধ উপস্থিত। হিন্দুশাস্ত্রমতে শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণভোজন করাইতে হইবে। কাহাকে নিমন্ত্রণ করিবে? মনুতে নিষেধ আছে যে, যে রাজার বেতনভুক্, তাহাকে খাওয়াইবে না ; যে বাণিজ্য করে, তাহাকে খাওয়াইবে না; যে টাকার সুদ খায়, তাহাকে খাওয়াইবে না; যে বেদধ্যয়নশূন্য, তাহাকে খাওয়াইবে না ; যে পরলোক মানে না, তাহাকে খাওয়াইবে না ; যাহার অনেক যজমান, তাহাকে খাওয়াইবে না, যে চিকিৎসক, তাহাকে খাওয়াইবে না; যে শ্রৌতস্মার্ত্ত অগ্নি পরিত্যাগ করিয়াছে, তাহাকে খাওয়াইবে না ; যে শূদ্রের নিকট অধ্যয়ন করে, কি শূদ্রকে অধ্যয়ন করায়, যে ছল করিয়া ধর্ম্মকর্ম্ম করে, যে দুর্জ্জন, যে পিতামাতার সহিত বিবাদ করে, যে পতিত লোকের সহিত অধ্যয়ন করে, ইত্যাদি বহুবিধ লোককে খাওয়াইবে না। এমন কথাও আছে যে, মিত্র ব্যক্তিকেও ভোজন করাইবে না। ইহা মুক্তকণ্ঠে বলা যাইতে পারে, মনুর এই বিধি অনুসারে চলিলে শ্রাদ্ধকর্ম্মে আজিকার দিনে একটিও ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় না। সুতরাং শ্রাদ্ধাদি পিতৃকার্য্য পরিত্যাগ করিতে হয়। অথচ যে বাপের শ্রাদ্ধ করিল না, তাহাকেই হিন্দু বলি কি প্রকারে? এইরূপ ভূরি ভূরি উদাহরণের দ্বারা প্রমাণ করা যাইতে পারে যে, সর্ব্বাংশে শাস্ত্রসম্মত যে হিন্দুধর্ম্ম, তাহা কোনরূপে এক্ষণে পুনঃসংস্থাপিত হইতে পারে না; কখন হইয়াছিল কি না, তদ্বিষয়ে সন্দেহ। আর হইলেও সেরূপ হিন্দুধর্ম্মে এক্ষণে সমাজের উপকার হইবে না, ইহা এক প্রকার নিশ্চিত বলা যাইতে পারে।
* ভিন্দ্যার্চৈ্চব তড়াগানি প্রাকারোপরিখাস্তথা ইত্যাদি। ৭ম অধ্যায়, ১৯৬।