শিষ্য। এক্ষণে বলুন, তবে এই ভক্ত কে?

গুরু। ভগবান্ স্বয়ং তাহা বলিতেছেন।

অদ্বেস্টা সর্ব্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এব চ।

নির্ম্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী ||

সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।

ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ সে মে প্রিয়ঃ ||

যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ।

হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্ম্মুক্তো যঃ সচ মে প্রিয়ঃ ||

অনপেক্ষঃ শুচির্দক্ষ উদাসীনো গতব্যথঃ।

সর্ব্বারম্ভপরিত্যাগী যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ ||

যো ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্টি ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।

শুভাশুভপরিত্যাগী ভক্তিমান্ যঃ স মে প্রিয়ঃ ||

সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ তথা মানাপমানয়োঃ।

শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জ্জিতঃ ||

তুল্যনিন্দাস্তুতির্ম্মৌনী সন্তুষ্টো যেন কেনচিৎ।

অনিকেতঃ স্থিরমতির্ভক্তিমান্ মে প্রিয়ো নরঃ ||

যে তু ধর্ম্মামৃতমিদং যথোক্তং পর্য্যুপাসতে।

শ্রদ্দধানা মৎপরমা ভক্তাস্তেহতীব মে প্রিয়াঃ || ১২।১৩-২০

“যে মমতাশূন্য (অর্থাৎ যার ‘আমার! আমার!’ জ্ঞান নাই,) অহঙ্কারশূন্য, যাহার সুখ দুঃখের সমান জ্ঞান, যে ক্ষমাশীল, যে সন্তুষ্ট, যোগী, সংযতাত্মা এবং দৃঢ়সঙ্কল্প, যাহার মন ও বুদ্ধি আমাতে অর্পিত, এমন যে আমার ভক্ত, সে-ই আমার প্রিয়। যাঁহা হইতে লোক উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না এবং যিনি লোক হইতে নিজে উদ্বেগ প্রাপ্ত হন না, যে হর্ষ অমর্ষ ভয় এবং উদ্বেগ হইতে মুক্ত, সে-ই আমার প্রিয়। যে বিষয়াদিতে অনপেক্ষ, শুচি, দক্ষ, উদাসীন, গতব্যথ, অথচ সর্ব্বারম্ভ পরিত্যাগ করিতে সক্ষম, এমন যে আমার ভক্ত, সে-ই আমার প্রিয়। যাঁহার কিছুতে হর্ষ নাই, অথচ দ্বেষও নাই, যিনি শোকও করেন না, বা আকাঙ্ক্ষা করেন না, যিনি শুভাশুভ সকল পরিত্যাগ করিতে সমর্থ, এমন যে ভক্ত, সে-ই আমার প্রিয়। যাঁহার নিকট শত্রু ও মিত্র, মান ও অপমান, শীতোষ্ণ, সুখ ও দুঃখ সমান, যিনি আসঙ্গ-বিবর্জিত, যিনি নিন্দা ও স্তুতি তুল্য বোধ করেন, যিনি সংযতবাক্য, যিনি সর্ব্বদা আশ্রয়ে থাকেন না, এবং স্থিরমতি, সেই ভক্ত আমার প্রিয়। এই ধর্ম্মামৃত যেমন বলিয়াছি, যে সেইরূপ অনুষ্ঠান করে, সেই শ্রদ্ধাবান্ আমার পরম ভক্ত, আমার অতিশয় প্রিয়।”

এখন বুঝিলে ভক্তি কি? ঘরে কপাট দিয়া পূজার ভান করিয়া বসিলে ভক্ত হয় না। মালা ঠক্‌ঠক্ করিয়া, হরি! হরি! করিলে ভক্ত হয় না; হা ঈশ্বর! যো ঈশ্বর! করিয়া গোলযোগ করিয়া বেড়াইলে ভক্ত হয় না; যে আত্মজয়ী, যাহার চিত্ত সংযত, যে সমদর্শী, যে পরহিতে রত, সে-ই ভক্ত। ঈশ্বরকে সর্ব্বদা অন্তরে বিদ্যমান জানিয়া, যে আপনার চরিত্র পবিত্র না করিয়াছে, যাহার চরিত্র ঈশ্বরানুরূপী নহে, সে ভক্ত নহে। যাহার সমস্ত চরিত্র ভক্তির দ্বারা শাসিত না হইয়াছে, সে ভক্ত নহে। যাহার সকল চিত্তবৃত্তি ঈশ্বরমুখী না হইয়াছে, সে ভক্ত নহে। গীতোক্ত ভক্তির স্থূল কথা এই। এরূপ উদার, এবং প্রশস্ত ভক্তিবাদ জগতে আর কোথাও নাই। এই জন্য ভগবদ্গীতা জগতে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।