ধর্ম্মতত্ত্ব
এ কথা বড় অধিক দূর গেল না। এ সকল উপনিষদের জ্ঞানবাদীরাও বলিয়া থাকেন। “শ্রদ্ধা” কথা ভক্তিবাচক নহে বটে, তবে শ্রদ্ধা থাকিলে সংশয় থাকে না, এ সকল ভক্তির বটে। কিন্তু আসল কথাটা বেদান্তসারে পাওয়া যায়। বেদান্তসারকর্ত্তা সদানন্দাচার্য্য উপাসনা শব্দের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন-“উপাসনানি সগুণব্রহ্মবিষয়কমানব্যাপাররুপাণি শাণ্ডিল্যবিদ্যাদীনি।”
এখন একটু অনুধাবন করিয়া বুঝ। হিন্দুধর্ম্মে ঈশ্বরের দ্বিবিধ কল্পনা আছে-অথবা ঈশ্বরকে হিন্দুরা দুই রকমে বুঝিয়া থাকে। ঈশ্বর নির্গুণ এবং ঈশ্বর সগুণ। তোমাদের ইংরেজিতে যাহাকে “Absolute” বা “Unconditioned” বলে, তাহাই নির্গুণ। যিনি নির্গুণ, তাঁহার কোন উপাসনা হইতে পারে না; যিনি নির্গুণ, তাঁহার কোন গুণানুবাদ করা যাইতে পারে না; যিনি নির্গুণ, যাহার কোন “Conditions of Existence” নাই বা বলা যাইতে পারে না - তাঁহাকে কি বলিয়া ডাকিব? কি বলিয়া তাঁহার চিন্তা করিব? অতএব কেবল সগুণ ঈশ্বরেরই উপাসনা হইতে পারে। নির্গুণবাদে উপাসনা নাই। সগুণ বা ভক্তিবাদী অর্থাৎ শাণ্ডিল্যাদিই উপাসনা করিতে পারেন। অতএব বেদান্তসারের এই কথা হইতে দুইটি বিষয় সিদ্ধ বলিয়া মনে করিতে পারি। প্রথম, সগুণবাদের প্রথম প্রবর্ত্তক শাণ্ডিল্য, ও উপাসনারও প্রথম প্রবর্ত্তক শাণ্ডিল্য। আর ভক্তি সগুণবাদেরই অনুসারিণী।
শিষ্য। তবে কি উপনিষদ্ সমুদায় নির্গুণবাদী?
গুরু। ঈশ্বরবাদীর মধ্যে কেহ প্রকৃত নির্গুণবাদী আছে কি না, সন্দেহ। যে প্রকৃত নির্গুণবাদী, তাহাকে নাস্তিক বলিলেও হয়। তবে, জ্ঞানবাদীরা মায়া নামে ঈশ্বরের একটি শক্তি কল্পনা করেন। সেই মায়াই এই জগৎসৃষ্টির কারণ। সেই মায়ার জন্যই আমরা ঈশ্বরকে জানিতে পারি না। মায়া হইতে বিমুক্ত হইতে পারিলেই ব্রহ্মজ্ঞান জন্মে এবং ব্রহ্মে লীন হইতে পারা যায়। অতএব ঈশ্বর তাঁহাদের কাছে কেবল জ্ঞেয়। সেই জ্ঞান ঠিক “জানা” নহে। সাধন ভিন্ন সেই জ্ঞান জন্মিতে পারে না। শম, দম, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান এবং শ্রদ্ধা, এই ছয় সাধনা। ঈশ্ববিষয়ক শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন ব্যতিরেকে অন্য বিষয় হইতে অন্তরিন্দ্রিয়ের নিগ্রহই শম। তাহা হইতে বাহ্যেন্দ্রিয়ের নিগ্রহ দম। তদতিরিক্ত বিষয় হইতে নিবর্ত্তিত বাহ্যেন্দ্রিয়ের দমন, অথবা বিধিপূর্ব্বক বিহিত কর্ম্মের পরিত্যাগই উপরতি। শীতোষ্ণাদি সহন, তিতিক্ষা। মনের একাগ্রতা, সমাধান। গুরুবাক্যাদিতে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা। সর্ব্বত্র এইরূপ সাধন কথিত হইয়াছে, এমত নহে। কিন্তু ধ্যান ধারণা তপস্যাদি প্রায়ই জ্ঞানবাদীর পক্ষে বিহিত। অতএব জ্ঞানবাদীরও উপাসনা আছে। উহা অনুশীলন বটে। আমি তোমাকে বুঝাইয়াছি যে, উপাসনাও অনুশীলন। তোমাকে বুঝাইয়াছি যে, উপাসনাও অনুশীন। অতএব জ্ঞানবাদীরও উপাসনা আছে। উহা অনুশীলন বটে। আমি অতএব জ্ঞানবাদীর ঈদৃশ অনুশীলনকে তুমি উপাসনা বলিতে পার। কিন্তু সে উপাসনা যে অসম্পূর্ণ, তাহাও পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছি, তাহা স্মরণ করিলে বুঝিতে পারিবে। যথার্থ উপাসনা ভক্তি-প্রসূত। ভক্তিতত্ত্বের ব্যাখ্যায় গীতোক্ত ভক্তিতত্ত্ব তোমাকে বুঝাইতে হইবে। সেই সময়ে এ কথা আর একটু স্পষ্ট হইবে।
শিষ্য। এক্ষণে আপনার নিকট যাহা শুনিলাম, তাহাতে কি এমন বুঝিতে হইবে যে, সেই প্রাচীন ঋষি শাণ্ডিল্যই ভক্তিমার্গের প্রথম প্রবর্ত্তক?
গুরু। ছান্দোগ্য উপনিষদে যেমন শাণ্ডিল্যের নাম আছে, তেমনি দেবকীনন্দন কৃষ্ণেরও নাম আছে। অতএব কৃষ্ণ আগে, কি শাণ্ডিল্য আগে, তাহা আমি জানি না; সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ কি শাণ্ডিল্য ভক্তিমার্গের প্রথম প্রবর্ত্তক তাহা বলিতে পারি না।