বলিতে বলিতে যাহার কথা ভাবিতেছিলেন, সে আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল। গুর্‌গণ খাঁ তাহাকে পৃথক আসনে বসাইলেন। সে দলনী বেগম।

গুর্‌গণ খাঁ বলিলেন, “আজি অনেকদিনের পর তোমাকে দেখিয়া বড় আহ্লাদিত হইলাম। তুমি নবাবের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া অবধি আর তোমাকে দেখি নাই। কিন্তু তুমি এ দুঃসাহসিক কর্ম কেন করিলে?”

দলনী বলিল, “দুঃসাহসিক কিসে?”

গুর্‌গণ খাঁ কহিল, “তুমি নবাবের বেগম হইয়া রাত্রে গোপনে একাকিনী চুরি করিয়া আমার নিকট আসিয়াছ, ইহা নবাব জানিতে পারিলে তোমাকে আমাকে—দুইজনকেই বধ করিবেন ।”

দ। যদি তিনি জানিতেই পারেন, তখন আপনাতে আমাতে যে সম্বন্ধ, তাহা প্রকাশ করিব। তাহা হইলে রাগ করিবার আর কোন কারণ থাকিবে না।

গুর্। তুমি বালিকা, তাই এমত ভরসা করিতেছ! এত দিন আমরা এ সম্বন্ধ প্রকাশ করি নাই। তুমি যে আমাকে চেন, বা আমি যে তোমাকে চিনি, এ কথা এ পর্যন্ত আমরা কেহই প্রকাশ করি নাই—এখন বিপদে পড়িয়া প্রকাশ করিলে কে বিশ্বাস করিবে? বলিবে, এ কেবল বাঁচিবার উপায়। তুমি আসিয়া ভাল কর নাই।

দ। নবাব জানিবার সম্ভাবনা কি? পাহারাওয়ালা সকল আপনার আজ্ঞাকারী—আপনার প্রদত্ত নিদর্শন দেখিয়া তাহারা আমাকে ছাড়িয়া দিয়াছে। একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমি আসিয়াছি—ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ হইবে এ কথা কি সত্য?

গুর্। এ কথা কি তুমি দুর্গে বসিয়া শুনিতে পাও না?

দ। পাই। কেল্লার মধ্যে রাষ্ট্র যে, ইংরেজের সঙ্গে নিশ্চিত যুদ্ধ উপস্থিত। এবং আপনিই এ যুদ্ধ উপস্থিত করিয়াছেন। কেন?

গুর্। তুমি বালিকা, তাহা কি প্রকারে বুঝিবে?

দ। আমি বালিকার মত কথা কহিতেছি? না, বালিকার ন্যায় কাজ করিয়া থাকি? আমাকে যেখানে আত্মসহায়স্বরূপ নবাবের অন্তঃপুরে স্থাপন করিয়াছেন, সেখানে বালিকা অগ্রাহ্য করিলে কি হইবে?

গুর্। হউক। ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে তোমার আমার ক্ষতি কি। হয়, হউক না।

দ। আপনারা কি জয়ী হইতে পারিবেন?

গুর্। আমাদের জয়েরই সম্ভাবনা।

দ। এ পর্যন্ত ইংরেজকে কে জিতিয়াছে?

গুর্। ইংরেজেরা কয়জন গুর্‌গণ খাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছে?

দ। সেরাজউদ্দৌলা তাহাই মনে করিয়াছিলেন। যাক—আমি স্ত্রীলোক, আমার মন যাহা বুঝে, আমি তাই বিশ্বাস করি। আমার মনে হইতেছে যে, কোন মতেই আমরা ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া জয়ী হইব না। এ যুদ্ধে আমাদের সর্বনাশ হইবে। অতএব আমি মিনতি করিতে আসিয়াছি, আপনি এ যুদ্ধে প্রবৃত্তি দিবেন না।

গুর্। এ সকল কর্মে স্ত্রীলোকের পরামর্শ অগ্রাহ্য।

দ। “আমার পরামর্শ অগ্রাহ্য করিতে হইবে। আমায় আপনি রক্ষা করুন। আমি চারিদিক অন্ধকার দেখিতেছি ।” বলিয়া, দলনী রোদন করিতে লাগিল।

গুর্‌গণ খাঁ বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “তুমি কাঁদ কেন? না হয় মীরকাসেম সিংহাসনচ্যুত হইলেন, আমি তোমাকে সঙ্গে করিয়া দেশে লইয়া যাইব ।”

ক্রোধে দলনীর চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। সক্রোধে তিনি বলিলেন, “তুমি কি বিস্মৃত হইতেছ যে, মীরকাসেম আমার স্বামী?”