গুরু। অসম্পূর্ণ হইতে পারে। সে কথাতেও কিছু সন্দেহ আছে। অসম্পূর্ণ হউক বা না হউক, কিন্তু ভ্রান্ত নহে। কেন না, সুখের উপায় যদি ধর্ম্ম হইল, আর ইহকালেও যে সুখ, পরকালেও যদি সেই সুখই সুখ হইল, তবে ইহকালেরও যে ধর্ম্ম, পরকালেরও সেই ধর্ম্ম। পরকাল নাই মান, কেবল ইহলোকে সার করিয়াও সম্পূর্ণরূপে ধার্ম্মিক হওয়া যায়। ধর্ম্ম নিত্য। ধর্ম্ম ইহকালেও সুখপ্রদ, পরকালেও সুখপ্রদ। তুমি পরকাল মান আর না মান- ধর্ম্মাচরণ করিও তাহা হইলে ইহলোকেও সুখী হইবে, পরকালেও সুখী হইবে।

শিষ্য। আপনি নিজে পরকাল মানেন-কিছু প্রমাণ আছে বলিয়া মানেন, না, কেবল মানিতে ভাল লাগে, তাই মানেন?

গুরু। যাহার প্রমাণাভাব, তাহা আমি মানি না। পরকালের প্রমাণ আছে বলিয়াই পরকাল মানি।

শিষ্য। যদি পরকালের প্রমাণ আছে, যদি আপনি নিজে পরকালে বিশ্বাসী, তবে আমাকে তাহা মানিতে উপদেশ দিতেছেন না কেন? আমাকে সে সকল প্রমাণ বুঝাইতেছেন না কেন?

গুরু। আমাকে ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, সে প্রমাণগুলি বিবাদের স্থল। প্রমাণগুলির এমন কোন দোষ নাই যে, সে সকল বিবাদের সুমীমাংসা হয় না, বা হয় নাই।তবে আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের কুসংস্কারবশতঃ বিবাদ মিটে না। বিবাদের ক্ষেত্রে অবতরণ করিতে আমার ইচ্ছা নাই এবং প্রয়োজনও নাই। প্রয়োজন নাই, এই জন্য বলিতেছি যে, আমি তোমাকে উপদেশ দিতেছি যে, পবিত্র হও, শুদ্ধচিত্ত হও, ধর্ম্মাত্মা হও। ইহাই যথেষ্ট। আমরা এই ধর্ম্ম ব্যাখ্যার ভিতর যত প্রবেশ করিব, ততই দেখিব যে, এক্ষণে যাহাকে সমুদায় চিত্তবৃত্তির সর্ব্বাঙ্গীণ স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি বলিতেছি, তাহার শেষ ফল পবিত্রতা-চিত্তশুদ্ধি।* তুমি পরকাল যদি নাও মান, তথাপি শুদ্ধচিত্ত ও পবিত্রাত্মা হইলে নিশ্চয়ই তুমি পরকালে সুখী হইবে। যদি চিত্ত শুদ্ধ হইল, তবে ইহলোকই স্বর্গ হইল, তখন পরলোকে স্বর্গের প্রতি আর সন্দেহ কি? যদি তাই হইল, তবে পরকাল মানা-না-মানাতে বড় আসিয়া গেল না। যাহারা পরকাল মানে না, ইহাতে ধর্ম্ম তাহাদের পক্ষ সহজ হইল ; যে ধর্ম্ম তাহার পরকালমূলক বলিয়া এত দিন অগ্রাহ্য করিত, তাহার এখন সেই ধর্ম্মকে ইহকালমূলক বলিয়া অনায়াসে গ্রহণ করিতে পারিবে। আর যাহারা পরকালে বিশ্বাস করে, তাহাদের বিশ্বাসের সঙ্গে এ ব্যাখ্যার কোন বিবাদ নাই। তাহাদের বিশ্বাস দিন দিন দৃঢ়তর হউক, বরং ইহাই আমি কামনা করি।

শিষ্য। আপনি বলিয়াছিলেন যে, ইহকাল-পরকালব্যাপী যে সুখ, তাহাই সুখ। একজাতীয় সুখ উভয় কালব্যাপী হইতে পারে। যে জন্মান্তর মানে না, তাহার পক্ষে এই তত্ত্ব যে কারণে গ্রাহ্য, তাহা বুঝাইলেন। যে জন্মান্তর মানে, তাহার পক্ষে কি?

গুরু। আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি, অনুশীলনের সম্পূর্ণতায় মোক্ষ। অনুশীলনের পূর্ণমাত্রায় আর পুনর্জ্জন্ম হইবে না। ভক্তিতত্ত্ব যখন বুঝাইব, তখন এ কথা আরও স্পষ্ট বুঝিবে।

শিষ্য। কিন্তু অনুশীলনের পূর্ণমাত্রা ত সচরাচর কাহার কপালে ঘটা সম্ভব নহে। যাহাদের অনুশীলনের সম্পূর্ণতা ঘটে নাই, তাহাদের পুনর্জ্জন্ম ঘটিবে। এই জন্মের অনুশীলনের ফলে তাহারা কি পরজন্মের কোন সুখ প্রাপ্ত হইবে?

গুরু। জন্মান্তরবাদের স্থূল মর্ম্মই এই যে, এ জন্মের কর্ম্মফল পরজন্মে পাওয়া যায়। সমস্ত কর্ম্মের সমবায় অনুশীলন। অতএব এ জন্মের অনুশীলনের যে শুভ ফল, তাহা অনুশীলনবাদীর মতে পরজন্মে অবশ্য পাওয়া যাইবে। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এ কথা অর্জ্জুনকে বলিয়াছেন।

* সকল কথা ক্রমে পরিস্ফুট হইবে।