ধর্ম্মতত্ত্ব
গুরু। মূর্খ! তৃণ জাতি পৃথিবী হইতে অন্তর্হিত হইলে অন্নাভাবে মারা যাইবে যে? জান না যে, ধানও তৃণজাতীয়? যে ভাঁটুই দেখিতেছ, উহা ভাল করিয়া দেখিয়া আইস। ধানের পাট হইবার পূর্ব্বে ধানও ঐরূপ ছিল। কেবল কর্ষণ জন্য জীবনদায়িনী লক্ষ্মীর তুল্য হইয়াছে। গমও ঐরূপ। যে ফুলকপি দিয়া অন্নের রাশি সংহার কর, তাহাও আদিম অবস্থায় সমুদ্রতীরবাসী তিক্তস্বাদ কদর্য্য উদ্ভিদ্ ছিল- কর্ষণে এই অবস্থান্তর প্রাপ্ত হইয়াছে। উদ্ভিদের পক্ষে কর্ষণ যাহা, মনুষ্যের পক্ষে স্বীয় বৃত্তিগুলির অনুশীলন তাই; এজন্য ইংরেজিতে উভয়ের নাম, CULTURE! এই জন্য কথিত হইয়াছে, যে, “The Substance of Religion is Culture.” “মানববৃত্তির উৎকর্ষণেই ধর্ম্ম।”
শিষ্য। তাহা হউক। স্থূল কথাও কিছুই বুঝিতে পারি নাই-মনুষ্যের সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি কাহাকে বলে?
গুরু। অঙ্কুরের পরিণাম, মহামহীরুহ। মাটি খোঁজ, হয়ত একটি অতি ক্ষুদ্র, প্রায় অদৃশ্য, অঙ্কুর দেখিতে পাইবে। পরিণামে সেই অঙ্কুর সেই প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের মত বৃক্ষ হইবে। কিন্তু তজ্জন্য ইহার কর্ষণ-কৃষকেরা যাহাকে গাছের পাট বলে, তাহা চাই। সরস মাটি চাই-জল না পাইলে হইবে না। রৌদ্র চাই, আওতায় থাকিলে হইবে না। যে সামগ্রী বৃক্ষশরীরের পোষণজন্য প্রয়োজনীয়, তাহা মৃত্তিকায় থাকা চাই-বৃক্ষের জাতিবিশেষে মাটিতে সার দেওয়া চাই। ঘেরা চাই। ইত্যাদি। তাহা হইলে অঙ্কুর সুবৃক্ষত্ব প্রাপ্ত হইবে। মনুষ্যেরও এইরূপ যে শিশু দেখিতেছ, ইহা মনুষ্যের অঙ্কুর। বিহিত কর্ষণে অর্থাৎ অনুশীলনে উহা প্রকৃত মনুষ্যত্ব প্রাপ্ত হইবে। পরিণামে সর্ব্বগুণযুক্ত, সর্ব্ব-সুখ-সম্পন্ন মনুষ্য হইতে পারিবে। ইহাই মনুষ্যের পরিণতি।
শিষ্য। কিছুই বুঝিলাম না। সর্ব্বসুখী সর্ব্বগুণযুক্ত কি সকল মনুষ্য হইতে পারে? গুরু। কখন হইতে পারিবে কি না, সে কথা এখন তুলিয়া কাজ নাই। সে অনেক বিচার। তবে ইহা স্বীকার করিব যে, এ পর্য্যন্ত কেহ কখন হয় নাই। আর সহসা কেহ হইবারও সম্ভাবনা নাই। তবে আমি যে ধর্ম্মের ব্যাখ্যানে প্রবৃত্ত, তাহার বিহিত অবলম্বনে ইহাই হইবে যে, লোকে সর্ব্বগুণ অর্জ্জনের জন্য যত্নে বহুগুণসম্পন্ন হইতে পারিবে; সর্ব্বসুখ লাভের চেষ্টায় বহু সুখ লাভ করিতে পারিবে।
শিষ্য। আমাকে ক্ষমা করুন-মনুষ্যের সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি কাহাকে বলে, তাহা এখনও ভাল করিয়া বুঝিতে পারিলাম না।
গুরু। চেষ্টা কর। মনুষ্যের দুইটি অঙ্গ, এক শরীর, আর এক মন। শরীরের আবার কতকগুলি প্রত্যঙ্গ আছে; যথা-হস্ত পদাদি কর্ম্মেন্দ্রিয়, চক্ষু কর্ণাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়; মস্তিষ্ক, হৃৎ, বায়ুকোষ, অন্ত্র প্রভৃতি জীবনসঞ্চালক প্রত্যঙ্গ; অস্থি, মজ্জা, মেদ, মাংস, শোণিত প্রভৃতি শারীরিক উপাদান, এবং ক্ষুৎপিপাসাদি শারীরিক বৃত্তি। এ সকলের বিহিত পরিণতি চাই। আর মনেরও কতকগুলি প্রত্যঙ্গ-
শিষ্য। মনের কথা পশ্চাৎ শুনিব; এখন শারীরিক পরিণতি ভাল করিয়া বুঝান। শারীরিক প্রত্যঙ্গ সকলের কি প্রকারে পরিণতি সাধিত হইবে? শিশুর এই ক্ষুদ্র দুর্ব্বল বাহু বয়োগুণে আপনিই বর্দ্ধিত ও বলশালী হইবে। তাহা ছাড়া আবার কি চাই?